দেশের অর্থনীতির বর্তমান হালচাল

প্রশান্তি ডেক্স ডলারের দাম, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহেও ঘটতি। রেমিট্যান্সও আসছে কম। আমদানির এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হরতাল-অবরোধ। তবে এর মধ্যেও অর্থনীতির অন্যতম সূচক সরকারের রাজস্ব আহরণ বেড়েছে। জনশক্তি রফতানিতে বড় ধরনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমে এসেছে। অর্থনীতি নিয়ে এখনই উদ্বেগের কিছু নেই বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।  

মূল্যস্ফীতি: দেশে গত নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমেছে, যা গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬৩ ও ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা নভেম্বরে কমে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে কমে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।

জনশক্তি রফতানি : জনশক্তি রফতানিতে বড় ধরনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ জনশক্তি রফতানি হয়েছে তা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ ৪ হাজার কর্মী প্রবাসে চাকরি নিয়ে গেছেন। গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার।

রাজস্ব আয় : চলতি ২০২৩-২৪ করবর্ষের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়কর, স্থানীয় পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এবং আমদানি-রফতানি শুল্ক মিলে মোট রাজস্ব আয় করেছে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা; যা গত করবর্ষের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। গত করবর্ষের প্রথম ৭ মাসে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।

ডলার : ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংক খাতে ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা। তবে বর্তমানে আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলার প্রতি ১২৪ থেকে ১২৫ টাকা আদায় করছে। সে হিসাবে এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। আর কার্ব মার্কেটে বা খোলা বাজারে ডলারের মূল্য ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।

ডলার সংকট কমাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানির জন্য এলসি খোলার শর্ত কঠোর করে সরকার। ফলে ব্যাংকগুলোও নিজেদের এলসি খোলা কমিয়ে দেয়। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে আমদানির পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ কমে যায়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আমদানির পরিমাণ ২৩ দশমিক ৯০ শতাংশ কমেছে।

রিজার্ভ : বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমেছে। গত সপ্তাহেই কমেছে ১২ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, গত ২৯ নভেম্বর রিজার্ভ কমে ১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার বা ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন বিলিয়নে নেমেছে। আগের সপ্তাহের বুধবারে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। তবে  প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কম। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সহসায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ ও বাজেট সহায়তা আসবে, ফলে চলতি মাসে রিজার্ভ কমবে না।

টাকার মান : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। তবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, টাকার মান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণার চেয়ে বেশি কমেছে। উদাহরণ দিয়ে তারা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে রিজার্ভ থেকে ১১০ টাকা ২৫ পয়সা রেটে ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু আমদানিকারকরা সর্বোচ্চ ১২৮ টাকা রেটে ডলার কিনছেন। এখানে পার্থক্য ১৭ টাকার বেশি।

প্রবাসী আয় : নভেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমেছে। এই মাসে বৈধ পথে ১৯৩ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। গত অক্টোবরের চেয়ে যা প্রায় ৫ কোটি ডলার কম। ওই মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।

এর আগে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আগস্টে এসেছে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের (জুলাই-নভেম্বর) পাঁচ মাসে রেমিট্যান্সে এসেছে ৮৮১ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ মার্কিন ডলার।

খেলাপি ঋণ : বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পরও কমছে না ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ২১ হাজার কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি।

বিদেশি ঋণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার। বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। ডলারের সংকট তৈরি হওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে চাপ তৈরি হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশ ঋণের বিপরীতে পরিশোধ করেছে ১২ হাজার ৮৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ১১১ টাকা দরে)। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করেছে ৬ হাজার ৯০৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের ৪ মাসে সুদ বাবদ পরিশোধ করেছে ৫ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের ৪ মাসে সুদ বাবদ পরিশোধ ছিল ১ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ সুদ পরিশোধ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

আমদানি-রফতানি : ডলার সংকটে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪ মাসে আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২৪ শতাংশ।

এদিকে নভেম্বরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য রফতানি হয়েছে ৪৭৮ কোটি ৪৮ লাখ ১০ হাজার ডলারের। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে যা ছিল ৫০৯ কোটি ২৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এই হিসাবে নভেম্বরে পণ্য রফতানি কমেছে বা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, টানা দুই মাস পণ্য রফতানি কমলো।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ওভেন পোশাকসহ বেশিরভাগ পণ্যের রফতানি কমে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য ইত্যাদি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ওভেন পোশাকের রফতানি কমেছে সাড়ে ৪ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন : বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমরা এখন ব্যালান্স অব পেমেন্টের সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আমি বলবো, এটা মাঝারি বা মডারেট ক্রাইসিস। অর্থনীতিতে গতি কমে এসেছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করে রেখেছে আমাদের কৃষি খাত। কৃষি খাতের পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিকে এখনও স্বস্তি দিচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। নানামুখী চাপের পরও রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। রাস্তা-ব্রিজসহ অবকাঠামো উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এছাড়া গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আশা করা হচ্ছে সামনে আরও কমে আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.