‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র’, জানার মাঝেও অজানা এক ইতিহাস

প্রশান্তি ডেক্স ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়সীমা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত দেশ-বিদেশে যা কিছু ঘটেছে, তার তথ্য ও দলিলপত্র সংগ্রহ এবং সেসবের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচিত আছে ১৪ খন্ডে। শহীদের সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা বলছেন, ইতিহাসের এই ১৪ খন্ড যদি আরও সহজলভ্য ও এর তথ্য যদি আরেকটু সহজবোধ্য করে এ সময়ের জন্য লেখা হয়, তবে তরুণ প্রজন্ম আগ্রহ নিয়ে ইতিহাস জানবে।

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের’ ভূমিকা অংশে লেখা আছে এর রচনা ও মুদ্রণের দায়িত্ব অর্পিত হয় মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্পের ওপর। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর কাজ শুরু হয় ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি থেকে। এই বইয়ের পরতে পরতে আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানান তথ্যাদি। প্রতিটি বইয়ে সুবিন্যস্ত আছে ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকালের  কথা।

কেন ইতিহাসের মতো করে রচনা না করে দলিলের ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান ভূমিকাতে লিখেছেন ‘ইতিহাস রচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও এই প্রকল্প স্বাধীনতা যুদ্ধ-সংক্রান্ত দলিল ও তথ্যগুলো প্রকাশনার সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করে। এর কারণ, সমকালীন কোনও ঘটনার, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো একটি যুগান্তকারী ঘটনার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করা এবং বিকৃতির সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া বস্তুত অত্যন্ত দুরূহ। এ জন্যই আমরা ইতিহাস রচনার পরিবর্তে দলিল ও তথ্য প্রকাশকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি।’

দলিলপত্রের প্রথম খন্ডে রয়েছে পটভূমি (১০৫-১৯৫৮), দ্বিতীয় খন্ডে পটভূমি (১৯৫৮-১৯৭১), তৃতীয় খন্ডে ‘মুজিবনগর: প্রশাসন’, চতুর্থ খন্ডে ‘মুজিবনগর: প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা’, পঞ্চম খন্ডে ‘মুজিবনগর: বেতারমাধ্যম’, ষষ্ঠ খন্ডে ‘মুজিবনগর: গণমাধ্যম’, সপ্তম খন্ডে ‘পাকিস্থানি দলিলপত্র: সরকারি ও বেসরকারি’, অষ্টম খন্ডে ‘গণহত্যা, শরণার্থী শিবির ও প্রাসঙ্গিক ঘটনা’, নবম খন্ডে ‘সশস্ত্র সংগ্রাম (১)’, দশম খন্ডে ‘সশস্ত্র সংগ্রাম (২)’, একাদশ খন্ডে ‘সশস্ত্র সংগ্রাম (৩)’, দ্বাদশ খন্ডে ‘বিদেশি প্রতিক্রিয়া: ভারত’, ত্রয়োদশ খন্ডে ‘বিদেশি প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘ ও বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশ্ব জনমত’, চতুর্দশ খন্ডে ‘বিশ্ব জনমত’, পঞ্চদশ খন্ডে ‘সাক্ষাৎকার’, ষোড়শ খন্ডে ‘কালপঞ্জী, গ্রন্থপঞ্জী ও নির্ঘণ্ট’ সন্নিবেশিত আছে।

দলিলপত্রের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান আরও লিখেছেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি, এমন অনেকের কাছেই দলিল ও তথ্যাদি রয়েছে, যা তারা হাতছাড়া করতে রাজি নন। অনেকেই কিছু ছেড়েছেন, কিছু হাতে রেখে দিয়েছেন। আবার কারও কারও প্রত্যাশা দলিলাদি পুরোনো হলে সেগুলো অনেক বেশি লাভের উৎস হয়ে উঠতে পারে। আমরা মূল দলিলের ফটোকপি রেখে অনেককেই তার মূল কপি ফেরত দিয়েছি।’

দলিল এবং তথ্য প্রামাণ্যকরণের জন্য সরকার ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রামাণ্যকরণ কমিটি গঠন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর মফিজুল্লাহ কবীর এই প্রামাণ্যকরণ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রামাণ্যকরণ কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল দলিলগুলো মূল যে ভাষায় আছে তাতেই ছাপা হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এতে বিশেষ অসুবিধা দেখা দেয়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় মূল দলিলগুলো সংকলনে স্থান পায়। তাছাড়া উর্দু, হিন্দি, আরবি ও রুশ ভাষার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল অনুবাদসহ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরার জন্য কী করণীয় জানতে চাইলে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান তৌহীদ রেজা নূর বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের ভাসা ভাসা জ্ঞানের কারণে আমাদের যে অর্জন, তা বিসর্জনের জায়গায় পৌঁছেছে। বোধগম্য করে সহজলভ্য করে এসব দলিল সামনে আনা দরকার এবং কেবল সামনে আনলেই হবে না, তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, রাষ্ট্র, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিটি ক্ষেত্রে বছরব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণামূলক ও প্রচারণামূলক কর্মকান্ড রাখা দরকার। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা কাজের সঙ্গে আগ্রহী তরুণদের ব্যাপক হারে যুক্ত করা দরকার।’

কীভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছাতে পারে, সে প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ও চিকিৎসক ডা. সারওয়ার আলী মনে করেন, ‘স্বাধীনতার আকাঙ্খার পটভূমির ওপর নজর দেওয়া খুব জরুরি এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকালীন যে বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ, সেটার সঠিক ইতিহাসকে সহজবোধ্য করে তাদের (নতুন প্রজন্মের) কাছে পৌঁছে দেওয়া। কাজটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করে যাচ্ছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষের যে বয়ান, সেটা কী করে সবার কাছে মানবিকভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রসহ যে বইগুলো ও দালিলিক প্রমাণগুলো আছে, সেগুলো কীভাবে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা যায়, সেদিকেও মনোযোগ দেওয়া দরকার।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.