প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ সিলেটের একটি সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সের শিক্ষার্থী ছিলেন উর্মি (ছদ্মনাম)। বিদেশে আসার আগ্রহ থেকে আইএলটিএস পরীক্ষা দিয়ে ভালো স্কোরও অর্জন করেন। কেয়ার ভিসায় ব্রিটেনে আসতে চাইলেও পরিবারের সেই আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। বাবাসহ স্বজনরা তাকে একা বিদেশে পাঠাতে রাজি না হওয়ায় পারিবারিকভাবে বিয়ের ব্যবস্থা হয় সিলেটের কুমার পাড়া এলাকার জাবেদ হোসেনের (ছন্দনাম) সঙ্গে। বিয়ের আগে তারা একে অপরকে চিনতেন না। এসএসসির পর লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া জাবেদের কাতার প্রবাসী বাবা দুজনের ব্রিটেনের কেয়ার ভিসার টাকার ব্যবস্থা করেন।
২০২২ সালের মার্চে উর্মি-জাবেদ দম্পতি লন্ডনে আসেন। কেয়ার ভিসার মূল আবেদনকারী উর্মিকে কাজ দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। জাবেদ শুরুতে কাজে গেলেও তার একার আয়ে বাসার ভাড়াই দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে জাবেদ রেস্তোরাঁর কাজ নিয়ে লন্ডনের বাইরে ওল্ডহামে চলে যান। উর্মি থেকে যান লন্ডনে খালার বাসায়। বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে উর্মি ওল্ডহামে গিয়ে জানতে পারেন সেখানে নিজের বিবাহিত খালাতো বোন সুমির সঙ্গে বসবাস করছেন জাবেদ। তখন তিনি জানতে পারেন সুমির সঙ্গে আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল জাবেদের।
প্রতিদিন সদ্য দেশ থেকে আসা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ, নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্ত্রী পুলিশ ডেকে স্বামীকে বের করে দিচ্ছেন, স্বামীর শারীরিক নির্যাতনে স্ত্রী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, জোর করে গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটছে। দাম্পত্য কলহের ঘটনায় পুলিশ ডাকার পর অনেকে স্বামী বা স্ত্রীর বিরুদ্ধে পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করছেন। অনেকে এসব মামলার সুযোগ নিয়ে ব্রিটেনে থিতু হওয়ার পথ খুজঁছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে সদ্য আসা এক নারী চাচা শ্বশুরের বাসায় যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগের পর চাচা শ্বশুরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার চাচার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দেওয়ার কারণে তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন তার স্বামী।
লিংকন্স চ্যাম্বার্স সলিসিটরসের প্রিন্সিপাল ব্যারিস্টার নাজির আহমদ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, গত তিন বছরে কয়েক হাজার বাংলাদেশি ব্রিটেনে কেয়ার ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ও স্টুডেন্ট ভিসায় স্বামী-স্ত্রী নিয়ে এসেছেন। তাদের অনেকে প্রায়ই আসছেন আমাদের কাছে ডিভোর্স নিয়ে পরামর্শ নিতে। অতীতে ব্রিটেনে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করলে কারণ দেখাতে হত। এখন আইন সহজ করায় অনেকে সুযোগটি নিচ্ছেন। ব্রিটেনে আসার পথ হিসেবে যারা স্পাউস বা সঙ্গী নিয়ে এসেছেন সেসব দম্পতিদের মধ্যে ডিভোর্স বেশি হচ্ছে। বিরোধের মূল কারণ অর্থনৈতিক। যে স্বপ্ন নিয়ে লন্ডনে তারা এসেছেন বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দালালের কথার সঙ্গে কাজের কোনও মিল থাকছে না। কাজ নেই। অনেক দম্পতি একসঙ্গে থাকতে পারছেন না, কারণ ঘর ভাড়া দেওয়ার মতো উপার্জন নেই। স্থায়ী হওয়ার আশা নিয়ে একা আসাদের মধ্যে অনেকে বিবাহিত মধ্য বয়সীদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াচ্ছেন।
স্টুডেন্ট ভিসায় স্ত্রীর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে লন্ডনে আসা ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা ফারুক আহমেদ কাজ করেন ক্রয়োডনের একটি সুপার স্টোরে। তিনি জানান, গত দুই বছরে এদেশে আসা তার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে তীব্র দাম্পত্য সংকটে রয়েছে। এখানে আসার পর দীর্ঘদিনের প্রেমের বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে মূলত আর্থিক কারণে। দেশ থেকে যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন বাস্তবতার সঙ্গে ফারাক আকাশ-পাতাল। ঘর ভাড়া আর সংসার খরচের জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজন দিনে দশ ঘণ্টা কাজ করেও যখন কুলিয়ে উঠতে পারছে না, তখন ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় টাকা কীভাবে জোগাড় হবে।
সাংবাদিক ও ব্রিটেনের লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা মাহবুবুল করীম সুয়েদ বলেন, দাম্পত্য কলহের পাশাপাশি যারা একা এসেছেন তাদের অনেকে স্থায়ী হওয়ার আশায় দ্বিগুণ বয়সী গৃহবধূর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, পুরনো সংসার ভাংছে। এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে। ডিভোর্স হওয়া মা-বাবার সন্তানরা ভুগছে বড় সমস্যায়।
লন্ডনের প্রবীণ কমিউনিটি নেতা কে এম আবু তাহের চৌধুরী বলেন, সংসার ভাঙ্গার বড় একটি কারণ হলো অনৈতিকতা। এসব ঘটনা বাংলাদেশিদের জন্য লজ্জার ও দুর্নামের। ডিপেন্ডেন্ট ভিসায় যারা আসছেন তাদের বড় একটি অংশ প্রতারিত হচ্ছেন, মেয়েরা ভিকটিম হচ্ছেন বেশি।
আবু তাহের চৌধুরী আরও বলেন, মূল কারণ হলো লন্ডনে এসে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল না হওয়া। আর্থিক কারণে ঘর ভাড়া দিতে না পারায় দেখা যাচ্ছে স্বামী হয়ত লন্ডনের বাইরে কাজ নিয়ে সেখানে থাকছেন, স্ত্রী থাকছেন কোনও আত্মীয়ের বাসায়। অনেকে ধারদেনা করে ভিসার টাকা জোগাড় করে এসেছেন। এখানে এসে কাজ পাচ্ছেন না, সেই ঋণ শোধ করতে পারছেন না। শুধু ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়া জন্য যারা এদেশে এসেছেন তাদের ক্ষেত্রে দাম্পত্য কলহ বেশি ঘটছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে ডিভোর্সের হার ছিল প্রায় ৪২ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই হার বেড়েছে। অযৌক্তিক আচরণ হলো ডিভোর্সের প্রধান কারণ। এছাড়া প্রায় ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে কারণ হলো ব্যভিচার।