শীত-কুয়াশায় বীজতলার ক্ষতি, বোরো আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

প্রশান্তি ডেক্স॥ ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীত জেঁকে বসেছে দিনাজপুরে। এতে বোরো ধানের বীজতলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। সূর্যের আলো ঠিকমতো না পাওয়ায় বোরোর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এরই মধ্যে হলুদ ও ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে ধানের চারা। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এখনও বীজতলার ক্ষতি হওয়ার মতো পরিবেশ হয়নি। মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর রেখে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

সদর উপজেলার চেহেলগাজী ইউনিয়নের কাটাপাড়া এলাকার বাবলু ইসলাম তিন একর জমিতে বোরো ধান রোপণের জন্য বীজ বুনেছেন। প্রচন্ড কুয়াশা আর শীতের কারণে গজাচ্ছে না চারা। কিছু চারা গজালেও মরে যাচ্ছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন এই কৃষক।

কুয়াশা আর শীত বেশি হলে বোরো বীজতলার চারা মরে যায় উল্লেখ করে বাবলু বলেন, ‘কুয়াশার কারণে বীজতলার চারা গজায় না। আমার বীজতলায় কিছু চারা গজিয়েছে, এখন মরে যাচ্ছে। এভাবে যদি চারা মরে যায়, তাহলে নতুন করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। আবার চারা রোপণ করতে দেরি হয়ে যাবে। তাতে ভালো ফলন পাওয়া যাবে না।’

শীতের কারণে ফসলের ক্ষতির কথা জানালেন সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের কৃষক লতিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এই শীত হামার জন্য সমস্যার। বেশি শীত হইলে ধানগুলা মরি যাবার ধরে। এখন যে বিচন (চারা) সেগুলা মরি যাবার ধরিছে। আবার যখন ধানগুলো লাগামো (রোপণ) তখন যদি শীত থাকে তখনও মরি যায়। ইরি (বোরো) সিজিনত হামার এইটাই বড় সমস্যা। আবার শাকসবজি ভালো হয়, কিন্তু আলু আর টমেটোত ফির ক্ষতি হয়। গাছগুলা মরি যায়।’

বাবলু কিংবা লতিফুর নন, শীত ও কুয়াশা জেলার বেশিরভাগ কৃষকের কপালে এনে দিয়েছে দুশ্চিন্তা। বীজতলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন তারা।

সরেজমিনে সদরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আলুর পাতা ঝলসে যাচ্ছে, গাছ মরে যাচ্ছে। শিম, বেগুন ও টমেটো ক্ষেতেরও একই অবস্থা। বোরো ধানের চারা গজাচ্ছে না, গজালেও মরে যাচ্ছে। এসব ফসল রক্ষায় প্রয়োজনীয় বালাইনাশক স্প্রে করেও সুফল পাচ্ছেন না কৃষকরা।

ধানের জেলা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে দিনাজপুরের। তবে এখন ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, আলু ও টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি উৎপাদনেও ভূমিকা রাখছে। হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় জেলায় শীতের তীব্রতা বেশি। চলতি মৌসুমে ঘন ঘন মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ফসলের ওপর আঘাত হেনেছে।

কৃষকরা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার টানা মৃদু শৈত্যপ্রবাহ তাদের ফসলকে বেশি ক্ষতির মুখে ফেলেছে। সেইসঙ্গে সূর্যের আলো ঠিকমতো না পাওয়ায় বোরোর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কীটনাশক স্প্রে করেও সুফল না পাওয়ার কথা জানালেন আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ি এলাকার কৃষক আলামিন হোসেন। তিনি বলেন, ‘সারারাত শীত পড়ছে। শিমের ফুল ঝরে যাচ্ছে, শিম পচে নষ্ট হচ্ছে। কীটনাশক স্প্রে করেও কোনও কাজ হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক গাছের পাতা হলুদ হয়ে গেছে।’

একই এলাকার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শিম, বেগুন ও করলাসহ নানা ফসল ঝরে পড়ছে। গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপি নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে আরও কয়েকদিন শীত থাকলে সব ফসল নষ্ট হবে।’

শেখপুরা ইউনিয়নের কৃষক সেলিম রেজা বলেন, ‘তীব্র শীতে আলুতে ব্যাপক হারে মড়ক রোগের আক্রমণ হচ্ছে। ঘন ঘন কীটনাশক দিতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এরপরও গাছগুলো বাঁচাতে পারবো কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। কারণ এবারের ঘন কুয়াশায় নানা কৃষি নষ্ট হয়ে গেছে, অধিকাংশ গাছ মরে গেছে।’

শীত ও কুয়াশায় টমেটো গাছগুলো কুঁকড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন একই ইউনিয়নের কৃষক বেনু রাম সরকার। তিনি বলেন, ‘সার ও কীটনাশক দিচ্ছি, কাজ হচ্ছে না। কৃষি কর্মকর্তারা যে পরামর্শ দিচ্ছেন সেটাই করছি, তবু গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। পাতাগুলোতে পচন রোগ দেখা দিয়েছে।’

সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাকিম হোসেন বলেন, ‘শীতের কারণে যাতে বোরো বীজতলা নষ্ট না হয়, সেজন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া এবং সেচ দিয়ে পরে পানি বের করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি কৃষকদের। সবজিসহ বিভিন্ন ফসলে বালাইনাশক স্প্রে করতে বলেছি।’

এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দিনাজপুরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. নূরুজ্জামান বলেন, ‘এখন বিভিন্ন ধরনের ফসল মাঠে রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে জেলায় বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। সেই সঙ্গে রয়েছে ঘন কুয়াশা। এ অবস্থায় আলু ও টমেটো ক্ষেতে পচন জাতীয় নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এজন্য কৃষকদের বালাইনাশক স্প্রে করাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বোরো ধানের বীজতলায় সেচ দিয়ে পানি ধরে রাখা এবং পরে বের করে দেওয়া, স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে বলা হচ্ছে কৃষকদের। ফসলের যে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা, তাপমাত্রা বাড়লে তা আর থাকবে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.