নজিরবিহীন চাপে মিয়ানমার জান্তা সরকার

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ জানুয়ারির মাঝামাঝিতে মিয়ানমারের একটি ক্যান্টনমেন্ট শহরে ছোট একটি সমাবেশে কট্টর সেনা সমর্থক বৌদ্ধ ভিক্ষু পাউক কোতাও জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, পদত্যাগ করে ডেপুটিকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটির ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, উপস্থিতরা সমর্থন জানিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছেন। অনলাইন, জান্তাপন্থি সাংবাদিক ও ব্লগাররাও একইভাবে সরাসরি এমন কথা বলছেন। সেনা সমর্থক এক ইউটিউবার কো মাউং মাউং বলেছেন, কমান্ডার-ইন-চিফের পদত্যাগ করা উচিত।

মাত্র কয়েক মাস আগেও মিয়ানমারের প্রভাবশালী জান্তা নেতা ও সশস্ত্রবাহিনীর প্রধানের প্রকাশ্যে এমন সমালোচনার কথা চিন্তাও করা যেত না। কিন্তু ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের তিন বছর পর মিন অং হ্লাইং নিজেকে এমন দুর্বল অবস্থানে দেখতে পাচ্ছেন।

অক্টোবরে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সমন্বিত হামলায় একের পর এক ফাঁড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো, গুরুত্বপূর্ণ শহরে সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার কারণে ৬৭ বছর বয়সী জান্তা প্রধানের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

মিয়ানমার পিস মনিটরের তথ্য অনুসারে, এখন পর্যন্ত জান্তা অন্তত ৩৫টি শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। যদিও চীন সীমান্তে বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় সংঘাত থেমেছে, কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে অব্যাহত রয়েছে।

বিদ্রোহীদের কাছে লড়াইয়ে ব্যর্থতার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না জান্তা। তবে অতীতে কিছু ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা স্বীকার করেছে তারা।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মিন অং হ্লাইংকে নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে গভীর হতাশা রয়েছে। অনেকেই তার পদত্যাগকে সমর্থন জানাবেন।

তিনি আরও বলেছেন, সেনাবাহিনী নতুন সেনা সদস্য সংগ্রহ করতেও জটিলতায় পড়ছে। এর ফলে লড়াইয়ের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি এমন সদস্যদেরও সম্মুখ সমরে পাঠানো হচ্ছে। এসব পদক্ষেপও জান্তা প্রধানের পক্ষে যাচ্ছে না। এই বিষয়ে জান্তার এক মুখপাত্র রয়টার্সের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি।

বিদ্রোহীদের কাছে ভূখন্ড ও ফাঁড়ি হারানোর কারণে সেনা শাসনের পতন হওয়ার সুযোগ কম। স্পষ্ট নয় মিন অং হ্লাইংকে দায়িত্ব ছাড়তে চাপ দেওয়া হবে কিনা কিংবা তার স্থলাভিষিক্ত কে হতে পারেন। তবে সাম্প্রতিক অগ্রগতি জান্তা প্রধান ও দেশটির সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে।

ক্রাইসিস গ্রুপ-এর সিনিয়র মিয়ানমার উপদেষ্টা রিচার্ড হরসে বলেছেন, জাতীয়তাবাদী ও সেনাবাহিনীর সমর্থকদের কাছে রণক্ষেত্রে চলমান পরাজয় লজ্জাজনক। এসব হারের পর জান্তা প্রধানের নেতৃত্ব নিয়ে নজিরবিহীন প্রকাশ্য সমালোচনা তারা শুরু করেছেন।

যারা তার নেতৃত্ব প্রশ্ন তুলছেন তাদের মধ্যে জান্তাপন্থি সাংবাদিকরাও রয়েছেন। সেনা শাসনের সমর্থক মোয়ে হেইন নিয়মিত রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে সামরিক বাহিনীর সিনিয়র নেতাদের নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, কোনও লড়াইয়ে জয় বা হার নির্ভর করে কমান্ডার ইন চিফ থেকে শুরু করে সেনা কমান্ডারদের ওপর।

মিয়ানমারে দায়িত্ব পালন করা সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েল বলেছেন, বিভিন্ন দিক থেকে চাপে রয়েছে সেনাবাহিনী। উল্লেখযোগ্য ভূখন্ড ও শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে তারা এবং বাহিনীর মনোবল ও নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ক্ষমতা গ্রহণের পর জান্তা অঙ্গীকার করেছিল ২০২৩ সালের আগস্টের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা হবে। কিন্তু গণতন্ত্রপন্থিদের বিক্ষোভ দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সেনাবাহিনী কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমন করে। এর ফলে তা দেশজুড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্ম হয় এবং আগে থেকে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে জান্তাবিরোধিতায় সমন্বয় গড়ে ওঠে।

পাশাপাশি, কয়েক দশক ধরে সেনাবাহিনীর প্রভাবিত শাসনে ইতোমধ্যে দুর্বল থাকা মিয়ানমারের অর্থনীতি আরও ধুঁকতে শুরু করে। অভ্যুত্থানের পর বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কামড় বসাতে শুরু করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাণিজ্য বিশ্লেষক বলেছেন, বিদ্যুৎ বিপর্যয়, জ্বালানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি এবং আকাশছোঁয়া দামের কারণে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ পরিবারগুলো। তাদের কাছে জান্তার জনপ্রিয়তা কমছে। সব শ্রেণির মানুষ নাজুক পরিস্থিতি টের পাচ্ছেন।

গত বুধবার প্রকাশিত গণতন্ত্রপন্থিদের গঠিত বিদ্রোহী সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) বলেছে, ছয়টি শর্ত মেনে নেওয়া হলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় তারা প্রস্তুত। এনইউজিতে অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া অং সান সুচির দল এবং তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে।

এনইউজির শর্তের মধ্যে রয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীকে বেসামরিক সরকারের অধীনে নিয়ে আসা এবং রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এনইউজি ও অপর গোষ্ঠীগুলো একটি কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক ঐক্য গঠন করতে চায়। এই বিবৃতির বিষয়ে মিয়ানমার জান্তার তাৎক্ষণিক কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

বিদ্রোহীদের হাতে লড়াই করার সময় খুব বেশি নেই। কারণ জুন মাসে বর্ষার মওসুম শুরু হয়ে যায় দেশটিতে। তখন লড়াই করা কঠিন। তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্সিয়েল মনে করেন, সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার সুযোগ রয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর। অন্তত তাদের অগ্রগতি সেনাবাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে পারে তারা। কিন্তু এমনটি হতে কত সময় লাগবে তা অনুমান করা কঠিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.