প্রশান্তি ডেক্স ॥ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ নামে নতুন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিষয়টি আসলে কী? কোন পদ্ধতিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে? এ নিয়ে অনেকের মধ্যে দেখা দিয়েছে কৌতূহল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রফতানি পণ্যের পরিধি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প শুরু করেছে মন্ত্রণালয়ের একাধিক শাখা। সারা দেশের জেলা ও উপজেলাভিত্তিক নির্দিষ্ট বা পরিচিত পণ্যের উৎপাদন ও প্রসারে কাজ করবে সংশ্লিষ্টরা। এতে অঞ্চলভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে কাঁচামালনির্ভর শিল্পায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নতুনই বলা যায়।
এর আগে বাণিজ্য মেলা উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হস্তশিল্পকে ২০২৪ বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা রফতানিতে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। একটা-দুইটা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকলে আমাদের চলবে না। আমাদের রফতানিকে বহুমুখী করতে হবে, এটা আমি বারবার বলছি। তৃণমূলের মানুষ যে উৎপাদন করবে, সেটাই তারা বাজারজাত করবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর নতুন এই কর্মসূচি হাতে নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২০১৬ সালে প্রণীত শিল্পনীতিতে ‘একটি গ্রাম একটি পণ্যে’র (ওয়ান ভিলেজ ওয়ান প্রোডাক্ট) প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেও আগের কোনও শিল্পনীতিতে এই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই ইতোমধ্যে রফতানি শাখা ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কর্মপরিকল্পনাও শুরু করেছে।
মূলত বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় কোনও না কোনও পণ্য পাওয়া যায়, যা অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। দেশের বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে নানা ধরনের পণ্য উৎপাদিত হয়। এসব পণ্যের দাম বা নাম অনেকেই জানেন না। কেউ খোঁজও রাখেন না। স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করা হয় বলে এসব পণ্যের পরিচিতিও বাড়ে না। এতে উদ্যোক্তারা সঠিক দাম পান না। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এসব পণ্য হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অহংকার। ছড়িয়ে পড়তে পারে বিদেশের বাজারেও। এখন ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ কর্মসূচির মাধ্যমে এসব পণ্য ধাপে ধাপে তুলে আনা হবে জাতীয় পর্যায়ে এবং রফতানি করার পরিকল্পনাও রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য : যে এলাকায় যে পণ্য বা কাঁচামাল বেশি উৎপাদিত হয়, সেই এলাকায় সংশ্লিষ্ট কাঁচামালের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া কীভাবে সহজ করা যায় এবং সেখানকার উদ্যোক্তাদের ব্যবহার্য কাঁচামালের জন্য অন্য কোনও এলাকার ওপর নির্ভর করতে না হয়, সেটা নিয়ে কাজ করবে মন্ত্রণালয়। এ পদ্ধতিতে এক এলাকার পণ্য অন্য এলাকায় এবং বিদেশেও রফতানি হবে। এতে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে প্রচুর।
যেমন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির গ্রাম হিসেবে পরিচিত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার বিন্না গ্রাম। এখানকার ক্রিকেট ব্যাট সরবরাহ করা হয় সারা দেশে। বিন্না গ্রাম ছাড়াও আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় এ শিল্প গড়ে ওঠে। এলাকার শত শত নারী-পুরুষ এই পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন তাদের এই খাতের এখন বেহাল দশা। করোনার ছোবল, প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, দাম কমে যাওয়া ও শিশু-কিশোরদের মোবাইলে আসক্তিসহ নানা কারণে ব্যাট উৎপাদন কমে গেছে। ফলে এই পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন কারিগররা।
জামালপুর দেশের সম্ভাবনাময় জেলা। একসময় এই জেলার নারীদের মধ্যে ঘরের বাইরে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কিছুটা অনীহা ছিল। এখন সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। কারণ জেলার নারীরা হস্তশিল্পে অনেক দূর এগিয়েছেন। জামালপুরের নকশিকাঁথার সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। জেলার নারীদের তৈরি দৃষ্টিনন্দন নকশিকাঁথা এবং অন্যান্য হস্তশিল্পপণ্যের চাহিদা ব্যাপক। জেলার অন্তত পাঁচ হাজার নারী উদ্যোক্তা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তবে পণ্য বাজারজাত করতে না পারায় নকশিকাঁথা তৈরির উদ্যোক্তা ও কর্মীরা ভালো দাম পাচ্ছেন না। পণ্যটির প্রচার-প্রসারও নেই সেভাবে। তাই নকশিকাঁথা নিয়ে তারা গর্বিত হয়ে উঠতে পারেননি।
বগুড়া সদর উপজেলার হরিপুরে অবস্থিত মিঠাইপল্লি। প্রতি বছরের শুধু পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সেখানে কারিগররা মুরালি, চিড়ার মোয়া, গুড়মাখা খই-মুড়ি, ফুল, নিমকি, খাঁজা, মাছ, কদমা, ছাঁচ (হাতি-ঘোড়া), খাগড়াই, বাতাসা ইত্যাদি মিঠাইপণ্য তৈরির কাজে ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। নামে মিঠাইপণ্য হলেও অধিকাংশ পণ্যই চিনি দিয়ে তৈরি। মিঠাইপণ্যগুলো কিনে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় ও দূরদূরান্তের পাইকার ও মেলাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা।
এভাবে ফরিদপুরের খেজুরের গুড়, নরসিংদীর সাগরকলা, বরিশালের আমড়া, নারকেলের ছোবড়ার দড়ি, পাপস, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, জামালপুরের নকশিকাঁথা, ঢাকাই জামদানি শাড়ি, যশোরের পাটালিগুড়ের নাম দেশবাসী জানলেও চোখে দেখা হয় না অনেকেরই।
উদ্যোক্তারা কি বলেন : জানতে চাইলে স্বরূপকাঠি উপজেলার বিন্না গ্রামের ব্যাটের কারিগর সুধানন্দ হালদার বলেন, নতুন প্রজন্মের কিশোর-তরুণদের মোবাইলে আসক্তি ও খেলাধুলায় আগ্রহ কমে যাওয়ায় ক্রিকেট ব্যাটের চাহিদা কমেছে। এ ছাড়া ব্যাট তৈরির কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণেও ক্রেতা কমেছে। সরকারের কাছ থেকেও কোনও পৃষ্ঠপোষকতা পাইনি।
এই এলাকার জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, স্বল্প মূল্যে কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারলে এই গ্রাম থেকেই দেশ-বিদেশে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট ব্যাট সরবরাহ করা সম্ভব। এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
জামালপুরের স্থানীয় নকশিকাঁথার কারিগর শেফালী বেগম বলেন, ঠিকমতো বাজারজাত করতে না পারায় আমরা উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পাই না। সরকারি সহায়তা পেলে আমাদের নকশিকাঁথা দেশে-বিদেশে রফতানির মাধ্যমে ভালো দাম পাবো বলে আশা করছি।
বগুড়ার মিঠাই কারখানার মালিক ও কারিগররা জানান, বগুড়ার মিঠাইপণ্য যায় ঢাকার রমনার বৈশাখী মেলা, আজিমপুরের মেলা, দোহারের নুরুল্যাপুরের সান্যাল ফকিরের মেলা, ধামরাইয়ের রথের মেলা, চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড়ের জব্বারের মেলা, কুষ্টিয়ার লালন মেলা, যশোরের মধুমেলা, ফরিদপুরের পল্লিকবি জসীমউদদীন মেলা, সাতক্ষীরার গোড়পুকুর মেলা, বরিশালের বানারীপাড়ার সূর্যমণি মেলা, ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া মেলা, দিনাজপুরের চরকাই মেলা, আমবাড়ী মেলা ও গোপালপুর চৌধুরী মেলা, জয়পুরহাটের গোপীনাথপুর মেলা, বগুড়ার পোড়াদহ, গাংনগর ও দাড়িয়াল মেলায়। এসব পণ্য জাতীয়ভাবে পরিচিতি না পাওয়ায় উদ্যোক্তারা ভালো দাম পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ তাদের।
গঠিত হবে উচ্চপদস্থ কমিটি: বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে একটি উচ্চপদস্থ কমিটি গঠনের কথা ভাবছে মন্ত্রণালয়। কমিটিতে সংশ্লিষ্ট অপরাপর মন্ত্রণালয় ও বিভাগকেও সংযুক্ত করা হতে পারে। পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনকে কাজে লাগাতে চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ লক্ষ্যে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সংযুক্ত করার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যে কমিটিগুলো সম্পন্ন হলে আগামী মার্চ থেকে শুরু করা হবে প্রকল্পের কর্মসূচি।
সরকার-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব পণ্য ঠিকমতো প্রদর্শন করা গেলে দেশের বাইরেও রফতানি করা সম্ভব। এতে স্থানীয় শিল্প লাভজনক হবে। এলাকায় কর্মসংস্থান বাড়বে। দেশের রফতানি পণ্যের ঝুড়ি সমৃদ্ধ হবে। বাড়বে বৈদেশিক আয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানিয়েছে, এ বছর ২৮তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হস্তশিল্পকে ২০২৪ সালের বর্ষপণ্য ঘোষণা করেছেন। এ কারণেই এ বছরের পুরোটা সময় এই পণ্য নিয়ে কাজ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশের কুটিরশিল্পের সঙ্গে নারীরা বেশি সম্পৃক্ত। নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হস্তশিল্প ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এসব ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হস্তশিল্পকে ২০২৪ বর্ষপণ্য ঘোষণা করায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। বিশ্বের অনেক দেশেই পাট ও প্লাস্টিক কম্বাইন্ড করে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করছে। আমাদের দেশেও প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের পণ্য উৎপাদনে উদ্যোগ নিতে হবে। এটি করতে পারলে এই শিল্প সামনে আরও এগিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ নির্ধারণ করে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় এবং সর্বশেষ ঢাকায় মেলা করা হবে। এই পণ্যকে এসএমই এবং ব্যাসিকের মাধ্যমে সহযোগিতা করা হবে। এর ফলে এসব পণ্য একদিকে যেমন রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে, অন্যদিকে স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। আমরা সেদিকেই যাচ্ছি।