বাআ॥ ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকে খুব সহজেই তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায় হচ্ছে লাহোর প্রস্তাবের পর থেকে ১৯৪৭-এর জুলাইয়ে জিয়াউদ্দিনের অভিমত প্রকাশ করা পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়, জিয়াউদ্দিনের অভিমত প্রকাশ থেকে ১৯৪৮-এর মার্চ অর্থাৎ জিন্নাহর ঘোষণা পর্যন্ত। তৃতীয় পর্যায়, ১৯৪৮-এর মার্চ থেকে ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
১৯৪২-৪৩ থেকে ১৯৪৭-এর জুলাই পর্যন্ত কালপর্বে ভাষা নিয়ে বুদ্ধিজীবী পর্যায়ের এই সীমিত বাদ-প্রতিবাদকে ভাষা আন্দোলনের বদলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নের বিতর্ক বলা যেতে পারে। ১৯৪৭-এর জুলাই থেকে ১৯৪৮-এর মার্চ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ জিন্নাহর ঘোষণা পর্যন্ত হিসেব করলে দেখা যায় ভাষার প্রশ্নে সাধারণ জনগণ সজাগ না হলেও দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ এবং ছাত্র-শিক্ষক-রাজনীতিবিদগণ ততদিনে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সজাগ হয়ে উঠেছেন এবং ছাত্র ও যুব নেতারা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বলা যেতে পারে, এটাই ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব। ভাষা আন্দোলনের এই সূচনা পর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি।
১৯৪৭-এর ২৭ নভেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অপরদিকে মুসলিম লীগ সরকারের ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে অবস্থানগ্রহণ অতিদ্রুত মুসলিম লীগের একটি অংশকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। যে কারণে ৫ ডিসেম্বর ‘৪৭ মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা চলাকালে মুসলিম লীগের ঐ অংশটি বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং ৬ ডিসেম্বর ছাত্র বিক্ষোভও অনুষ্ঠিত হয়।
বাঙ্গালির স্বার্থের প্রশ্নে সরকারি দল মুসলিম লীগের ক্রম-পিছু হটা; অপরদিকে আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায়ের বিকল্প পথ ক্রমান্বয়ে ফুরিয়ে যাওয়ায় জনগণের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
তবে ১৯৪৮-এর পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু দেশের সচেতন অংশ ছাড়া সাধারণ জনগণের পাকিস্থান এবং জিন্নাহর প্রতি এক ধরনের আস্থা ছিল, তাই দেশের সচেতন জনগণের অংশ হিসেবে তখন কেবলমাত্র সম্ভব ছিল একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলা; যে সংগঠন নিয়েই মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল আর এই ঐতিহাসিক দায়িত্বটি পালনে এগিয়ে এলেন তরুণ সাহসী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তারই উদ্যোগে ও একান্ত চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ। এটিই ছিল পরবর্তীকালে জনগণের সংগঠন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সূতিকাগার এবং এই সংগঠনই পরবর্তীকালে ছাত্রলীগ নামে বাংলা ও বাঙালির দাবি আদায়ের প্রধান ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিরুদ্ধবাদী আবদুল মতিন বলেনঃ
“শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা বেশ কয়েকজন ছাত্র শাহ আজিজুর রহমানের কাছে গেলাম। শাহ আজিজ ছিলেন নিখিল পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবুর রহমান শাহ আজিজকে নিখিল পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলসভা ডাকার জন্য অনুরোধ করেন। শাহ আজিজ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব অনুযায়ী কাউন্সিলসভা ডাকতে রাজি হলেন না। শাহ আজিজ খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারের সমর্থক। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা এগিয়ে আসুন, আমরা নতুন করে ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলি। আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলাম। মোগলটুলির ওয়ার্কার্স ক্যাম্প কর্মীরা শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিলেন। আল আহাদ, নঈমউদ্দিন আহমদ, আব্দুর রহমান চৌধুরী, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আমিসহ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কর্মী সভায় বসি। এই সভায় পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা সংগঠনের মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার জন্য দাবি জানান। এই দাবির বিরোধিতা করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এই সময় এটা বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ সরকার ভুল ব্যাখ্যা দেবে। পরে সময় হলে বাদ দেওয়া যাবে। আমি শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্যের সমর্থক জানালাম। মুসলিম’ শব্দটি রাখা হলো।”
এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা যে কতখানি দূরদর্শিতাপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কাজ ছিল সে কথা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ বাংলা ও বাঙালির কোন দাবিই পাকিস্থানিদের কাছ থেকে রাজপথের আন্দোলন ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে আদায় করা যায়নি। আর রাজপথে দাবি আদায় তখনই সম্ভব হয়েছে যখন একটি সুসংগঠিত সংগঠন পশ্চাতে থেকেছে। বঙ্গবন্ধু শুরুতেই এ জরুরি কাজটিতে হাত দিয়েছিলেন।
৪ জানুয়ারি ১৯৪৮-এ পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হবার পর ৮ জানুয়ারি এ সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে তার বাসভবনে আলোচনায় বসে।
কিন্তু ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলার সপক্ষে গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে দাবি উত্থাপন করেন তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি তোলেন, গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি পাকিস্থানের ৫৬ ভাগ জনগোষ্ঠীয় ভাষা বাংলাকে রাখা হোক। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়া এবং পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু’ ু এই মর্মে লিয়াকত আলি খানের ঘোষণা ঢাকায় পৌছানোর সাথে সাথে ঢাকার ছাত্রসমাজ ও সচেতন ব্যক্তিবর্গ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ছাত্রসমাজ তাৎক্ষণিকভাবে পরবর্তী দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট ও প্রতিবাদসভার ডাক দেয়। ঐ প্রতিবাদসভায় সরকারি নীতির বিরুদ্ধে আগামীদিনের বৃহত্তর কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমুদুন মজলিশ যৌথভাবে ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অপরদিকে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগ সরকারের প্রকৃত অবস্থান সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনে আর কোন দ্বিধা থাকল না। তিনি স্থির করলেন ভাষার প্রশ্নে পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর অপরাপর অংশকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।
১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস কর্মসূচি ঘোষিত হবার সাথে সাথে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। সরকার এ প্রতিবাদ কর্মসূচি বানচাল করার যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়। অপরদিকে ভাষার প্রশ্নে এই প্রথম প্রত্যক্ষ রাজপথের আন্দোলনে সেদিন ছাত্র ও যুবনেতারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিবাদসভা, বিক্ষোভ ও সাধরণ ধর্মঘটের মধ্যমে ১১ মার্চের প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদকে ঐদিন সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিংরত অবস্থায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
মুসলিম লীগ সরকারের এই দমননীতি আন্দোলনকে আরো তীব্র করে তোলে । ১১ মার্চের পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৪ মার্চ সারা প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। ১৪ মার্চের হরতাল ও বিক্ষোভে ভীত হয়ে সরকার তৎকালীন সামরিক বাহিনীর জিওসি ও পরবর্তীকালে সামরিক সরকারপ্রধান আইয়ুব খানকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের গতি এতই তীব্র ছিল যে, সরকার শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আপোস মীমাংসার প্রস্তাব পাঠান। নাজিমুদ্দিনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিপূর্বে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আলোচ্যসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়। ঐ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আলোচনা হয় ও একটি আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সংগ্রাম পরিষদের নেতাগণ জেলে থাকার কারণে কামরুদ্দিন আহমদ ও আবুল কাসেম চুক্তির খসড়াটি জেলখানায় নিয়ে যান। শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজবন্দীগণ চুক্তির প্রতি সম্মতি দেবার পর সরকারের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন আহমদ তাতে স্বাক্ষর করেন।
এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতা মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে শেখ মুজিব এ্যাসেম্বলি ঘেরাও করার জন্য মিছিল নিয়ে এগিয়ে যান এবং আইন পরিষদের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময় বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে। পুলিশের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয় এবং তা পালিত হয়।
১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। একটু দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, মুখ্যমন্ত্রী চুক্তি করেন এমন একটি সময়ে যখন পাকিস্থানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার আর মাত্র চারদিন বাকি। ধূর্ত মুসলিম লীগ সরকার এই চুক্তিটিকে একটি ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করবে এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থাৎ জিন্নাহর ঢাকা আগমনের প্রাক্কালে যাতে বড় ধরনের কোন গোলযোগ না হয় সেজন্য মুসলিম লীগ সরকার তড়িঘড়ি এ আপোসরফা করে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তরুণ নেতা শেখ মুজিব ১৫ তারিখে সরকার ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক জেল থেকে বের হয়ে এলেন ঠিকই, কিন্তু বাইরে এসেই তিনি আন্দোলনকে বেগবান করলেন। ইতিপূর্বেকার পুলিশী জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র- জনতার যে সমাবেশ কর্মসূচি ছিল সেটি শুধুমাত্র প্রতিবাদ সমাবেশ হিসেবে শেষ হতে পারতো। কিন্তু সমাবেশের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সমাবেশ সংক্ষিপ্ত হয় এবং এ্যাসেম্বলি ঘেরাও-এর কর্মসূচি নেয়া হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন আরো এগিয়ে যায় । এমনি এক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে জিন্নাহ ঢাকা এলেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় জিন্নাহ যখন ঘোষণা দিলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্থানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা তখন শেখ মুজিবসহ তরুণ নেতাদের কেউ কেউ জনসমাবেশের মধ্য থেকে তৎক্ষণাৎ এর প্রতিবাদ করেন। স্পষ্টত বোঝা যায়, বাংলাকে পাকিস্থানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার এবং একে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য প্রাদেশিক পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন ও তা কার্যকর করতে বঙ্গবন্ধু তকালীন সরকারের উপর অব্যাহত চাপ প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
সেদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্যের এই যে প্রতিবাদ, সেখান থেকেই ভাষা আন্দোলনের আরেক অধ্যায় শুরু হলো। এই অধ্যায়েরই চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটতে দেখা যায় ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে।
মুসলিম লীগ সরকার যে বাঙালি ও বাংলা ভাষার প্রশ্নে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে অবস্থান নেবে এ সত্য শেখ মুজিবসহ বেশ কয়েকজন তরুণ নেতা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা এও বুঝেছিলেন যে, মুসলিম লীগ সরকারের এই গণবিরোধী কার্যকলাপ কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে প্রয়োজন সংগঠিত শক্তি। তাই এ লক্ষ্যেই ১৯৪৭-এর ৭ সেপ্টেম্বর তারা গঠন করেন পূর্ব পাকিস্থান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। কিন্তু গণতান্ত্রিক যুবলীগ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌছাতে সক্ষম হচ্ছিল না। তরুণ নেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবই উপলব্ধি করলেন যে, এ মুহূর্তে পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক কোন নাম নিয়ে রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না, বরং অসাম্প্রদায়িকতাকে অন্তরে ধারণ করেই এগুতে হবে। কারণে তিনি যেমন ছাত্রলীগের সঙ্গে মুসলিম’ শব্দটি রাখার পক্ষপাতী ছিলেন, তেমনি জিন্নাহর ভাষা সংক্রান্ত ঘোষণার পর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হলে সেখানেও বহাল থাকলো ‘মুসলিম’ শব্দটি। আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মের সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। তবু তিনি যে এই দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সেটা বোঝা যায় ঐ তরুণ বয়সে (তখন বয়স মাত্র ২৯ বছর) তাঁর যুগ্ম-সম্পাদক পদ অলঙ্কৃত করা থেকে। তাছাড়া ইতিমধ্যেই ভাষা ও অন্যান্য রাজনৈতিক প্রশ্নে তরুণ শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সামনের সারিতে চলে এসেছেন এবং সাহস ও দৃঢ়তায় ছাড়িয়ে গেছেন প্রায় সবাইকে। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এদিকে দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে ছাত্রলীগ নেতা দবিরুল ইসলাম, নূরুল হুদা, কাদের বক্স, এম. আ. আখতার মুকুল গ্রেফতার হন। তাদের উপর পুলিশী নির্যাতনের খবর পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে উপস্থিত হলেন। বারো ঘণ্টার নোটিশে জেলা প্রশাসক তাকে বহিষ্কার করেন এবং এই সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৯-এর মার্চ মাসে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্যান্যদের সঙ্গে প্রথমে জরিমানা এবং পরবর্তীতে বহিষ্কার করা হয়। মুচলেকা ও ১৪ টাকা জরিমানা দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান অন্যান্যদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে পারতেন। ঠিকই; কিন্তু সেদিনকার আপোসহীন তরুণ নেতা শেখ মুজিব মুচলেকা না দিয়ে মাথা উঁচু করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এলেন।
মুসলিম লীগ সরকার ও পাকিস্থানী সামরিক-বেসামরিক আমলাগোষ্ঠী সেদিন এটি বুঝতে পেরেছিলো যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মাথা কোন ব্যক্তিস্বার্থের লোভ দেখিয়ে কেনা যাবে না। তাই তারাও বেছে নেয় একের পর এক নির্যাতন-নিপীড়নের পথ। আর এ জন্যেই ভাষার প্রশ্নে যখন চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিতে-সেসময় আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে পাই কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে একজন বন্দী হিসেবে।
শেখ মুজিব বন্দী অবস্থায়ও নিশ্চুপ ছিলেন না, ভাষার দাবিতে অনশন করছিলেন। বাইরের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির উপরও তার প্রভাব কতখানি সেটা বোঝা যায় ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের বর্ণনায়।
“১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠছে তখন শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বন্দী থাকা অবস্থায়ও নিশ্চুপ ছিলেন না। পরামর্শ দিয়েছেন এবং কারাগারে বন্দী থেকেও আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। ..১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে উর্দুকে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শামসুল হক চৌধুরীর উদ্যোগে ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনের সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু তখন চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ৩ ফেব্রুয়ারি শামসুল হক চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ ও ডাঃ গোলাম মাওলার মাধ্যমে মুজিব ভাই সংবাদ পাঠালেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডেকে মিছিল করে ব্যবস্থাপক পরিষদ সভা ঘেরাও করা যায় কিনা বিবেচনা করে দেখতে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল শেষে বেলতলায় ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা হলো।
একথা স্পষ্ট যে, জেলখানায় বন্দী রেখেও বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন থেকে। “তখন চারদিক উত্তাল রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে। নারায়নগঞ্জ ও উত্তাল ছিল।এদিকে আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিব ও তার সহযোগী মহিউদ্দিন অনশন করে বসেন রাষ্ট্র ভাষা বাংলা করা এবং তাদের মুক্তির দাবিতে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ঢাকা কারাগার থেকে খুবই গোপনে পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠী শেখ মুজিব কে গোপনে ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেন। তখনকার সময়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুর যেতে হলে নারায়নগঞ্জ থেকে স্টিমারে করে যেতে হত। বঙ্গবন্ধু এ সুযোগ লুফে নেন, তিনি ফরিদপুরে যাওয়ার আগে যাত্রাবিরতিতে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের তাদের ভাষার দাবিতে অনশনের কথা জানিয়ে দেন এবং রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে কঠোর কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান। কারণ নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী ছিলো।এরপর নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে থাকে ভাষার দাবিতে উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্থানীয় জনসাধারণ ২০ তারিখ ২১ তারিখে পুরো নারায়নগঞ্জ অচল করে দেন।”
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের অকুতোভয় আন্দোলন, সালাম, রফিক, শফিউরের অকাতরে প্রাণদান, সমগ্র ঢাকা শহর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, গণপরিষদে মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের সাহসী ভূমিকা এ সবকিছু মুসলিম লীগ সরকারকে আবার পিছু হটতে বাধ্য করে। ফলে ১৯৫২’র ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠিত জানাজা ও হরতালের কর্মসূচির তীব্রতা দেখে ঐদিনই সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে বাংলাকে পাকিস্থানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব পাস করতে বাধ্য হন।
ভাষা আন্দোলনের একটি পর্যায়ের এখানে সমাপ্তি ঘটে ঠিকই; কিন্তু ‘৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার ভেতর দিয়ে পাকিস্থান নামক রাষ্ট্র ও মুসলিম লীগ সরকার সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মানুষের অনেকখানি মোহমুক্তি ঘটে। পশ্চিম পাকিস্থান ও মুসলিম লীগ সরকার যে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বার্থে নয় একথাটি সাধারণ জনগণও ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করে। এ সময়ে পূর্ব বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুণ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের গণবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে জনগণকে আরো সচেতন করে তুলতে সচেষ্ট হন। নেতৃবৃন্দের কঠোর পরিশ্রমে ১৯৫৪ সালের আগেই পূর্ব বাংলার জনগণ মুসলিম লীগ সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমর্থ হয়, যার ফলে ১৯৫৪’র সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক সমাধি রচিত হয়। এবং বাঙালিদের নির্বাচনী জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করে। অতঃপর ১৯৫৬’র সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সূত্রঃ ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু