‘৩০লক্ষ্য শহীদের বিষয়টি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাষ্টিসে লিপিবদ্ধ হলো’

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স॥ নেদারল্যান্ডসের হেগে ২০ ফেব্রুয়ারি প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে (আইসিজে) বাংলাদেশ বিবৃতি প্রদান করে। নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহর বিবৃতি মূলত প্যালেস্টাইন ইস্যুতে হলেও একই বিবৃতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানির কথাটি উল্লেখ করেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকান্ডের বিষয়টি ওই আদালতে উল্লেখ করার মাধ্যমে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘কোর্টে আমাদের স্টেটমেন্ট ইতোমধ্যে রেকর্ড হয়ে গেছে।’

প্যালেস্টাইন ইস্যুতে বক্তব্য দিতে গিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে রাষ্ট্রদূত প্যালেস্টাইন নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে সেটির সঙ্গে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রসঙ্গটি আছে এবং এটি মেনে নেওয়া হয়েছে এবং রেকর্ড করা হয়েছে।‘

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক মঞ্জুর হাসান বলেন, ’ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে এটি বলার মাধ্যমে পৃথিবীর অনেকে প্রথমবারের মতো এটি জানতে পারলো অথবা যারা আগে জানতো তারাও আবার সেটি শুনলো এবং এর সবকিছুর একটি গুরুত্ব আছে।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের পরিচালক (গবেষণা) ড. এম সানজীব হোসেন বলেন, ‘ভবিষ্যতে অন্য যেকোনও লেখায় বলতে পারবো যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে আমরা আমাদের একটি সাবমিশনে গণহত্যার কথাটি বলেছিলাম।’

গণহত্যা নিয়ে গবেষণাকারী সানজীব হোসেন জানান যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস অথবা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে এর আগে কেউ ৩০ লাখ জীবন বিসর্জনের কথা বলেছে কিনা আমার জানা নেই।

ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে ২০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত হামিদুল্লাহ ২১ মিনিটের বক্তব্য প্রদানের শুরুতেই বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষের জীবন বিসর্জনের কথা উল্লেখ করে সেটিকে প্যালেস্টাইন ইস্যুর সঙ্গে তুলনা করেন।

বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্যের তাৎপর্য : প্যালেস্টাইন ইস্যুতে কথা বললেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি আনার কারণে সেটিও কোর্টে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এটি রেকর্ড হয়েছে এবং কেউ এটি অস্বীকারও করেনি। এখন যেটি দরকার সেটি হচ্ছে চেষ্টা করা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের।’

বাংলাদেশ চেষ্টা করছে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা হয়েছিল সেটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এবং সেক্ষেত্রে এটি অবশ্যই একটি ভূমিকা রাখতে পারে। এটি ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটেরিয়াল বা প্রমাণ হিসাবে দাখিল করা যাবে। বলতে পারবো যে আমরা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে এই বক্তব্য দিয়েছিলাম এবং কেউ এটির প্রতিবাদ করেনি। এখন যেটি দরকার সেটি হচ্ছে চেষ্টা করা যে পাকিস্থানি বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল এটি বলা, তিনি জানান।

কোর্টে বাংলাদেশ যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে ভবিষ্যতে সেটি সহায়তা করবে কিনা জানতে চাইলে মঞ্জুর হাসান বলেন, ‘অবশ্যই। এখন এটি কোর্টে রেকর্ডভুক্ত হয়ে গেছে। এখানে যে সংখ্যাটি বলা হয়েছে, সেটি আমরা আগেও বলেছি এবং এটি ইতিহাসবিদসহ অন্যরা মেনে নিয়েছেন।’

তিনি বলেন, আমরা যেখানেই এই বিষয়টি উল্লেখ করি না কেন, সেটির একটি মূল্য আছে। এটি আমরা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছি।

গবেষণা পরিচালক ড. এম সানজীব হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে গণহত্যা হয়েছিল। গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী যে জঘন্য কাজগুলো করা হয়ে থাকে সেগুলো ১৯৭১ সালে হয়েছিল।’

তবে তিনি বলেন, যে কেউ বলতে পারে গণহত্যা হয়েছে। কিন্তু এটিকে আইনিভাবে প্রমাণ করতে হবে এবং এজন্য অনেক চেষ্টা করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কাজ করতে চায়, তবে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। বাংলাদেশে ৩০ লাখ লোক মারা গেছে বলে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু ওই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের কোনও বই লেখা হয়নি। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানের কোনও আইন জার্নালেও আমাদের এ বিষয়ে লেখা নেই। এগুলো করা হলে গোটা স্বীকৃতি আদায়ের প্রক্রিয়াটি সহজ হবে।’

আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা।

রাষ্ট্রদূত হামিদুল্লাহ তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও বাংলাদেশের সংবিধানের যে রেফারেন্স দিয়েছেন সেটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, “আমাদের স্টেটমেন্টে রাষ্ট্রদূত আরেকটি খুব ভালো রেফারেন্স দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে আলজিয়ার্সে নন-এলাইনড মুভমেন্টের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত এবং আমরা শোষিতের পক্ষে।’ এখান থেকেই সংবিধানের ২৫ ধারাটি এসেছে।”

আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। কিন্তু এরপরও আমরা শোষিতের পক্ষ নিয়ে থাকি। এটি আমাদের আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি যে শ্রদ্ধা সেটি প্রকাশ পায় বলে তিনি জানান। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধা ও আনুগত্য রয়েছে, সেটি আমাদের সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে প্যালেস্টাইন নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে আমরা যা বলেছি সেটিতে ওই সংবিধানকেই রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.