বাআ ॥ মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তেমনই কেড়ে নিয়েছে বহু বুদ্ধিজীবী, আত্মার আত্মীয়দের। বহু নারী হয়েছেন স্বামী, সন্তান হারা অনেকের কাছেই যুদ্ধের স্মৃতি হয়ে উঠেছে এক তমসাচ্ছন্ন রাত্রি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্থানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনগণ। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে।
২৬শে মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে ঢাকায় পাকিস্থানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই রাতেই গড়ে ওঠে প্রতিরোধ, শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামে ৩০ লাখ শহিদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর।
বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের ঐ নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা হয়েছিল একাত্তরের মার্চের শুরুতেই। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো। আপামর জনতা বিদ্রোহ-ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাবেশে পতাকা উত্তোলন। ৩ মার্চ ঘোষণা হলো পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার, জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। বহুপ্রতীক্ষিত ৭ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। অসহযোগ আন্দোলন, যুদ্ধের প্রস্তুতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ। পাকিস্থানি জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেদিন গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। এর দশ দিন আগে তিনি এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্থানের এই রাজধানী। পাকিস্থানি শাসকরা ভেবেছিল যে সবাইকে বুঝি ধোঁকা দেওয়া গেছে। কিন্তু সেই সময়ে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার বই ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ এ লিখেছেন: “মুজিবের গোয়েন্দারা গোটা খেলাটা বুঝে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের নিরাপত্তা টিমে কর্মরত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ আর চৌধুরী দেখে ফেলেছিলেন যে একটা ডজ গাড়িতে ইয়াহিয়া খানের মালপত্র বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। তিনি সেটা শেখ মুজিবের কাছে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যে সাতটার সময়ে ইয়াহিয়া খান যখন বিমানে চড়ার জন্য এয়ারফোর্স গেট দিয়ে ঢুকছেন, তখন নিজের দপ্তরে বসে গোটা দৃশ্যটা দেখছিলেন উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। ফোন করে শেখ মুজিবকে খবরটা জানিয়ে দেন তিনি।”মি. সালিক আরও লিখছেন, “ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে এক বিদেশী সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন যে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন, এই খবরটা আমি নিশ্চিত করতে পারি কী না!”রাত তখন বেশ গভীর। কে জানত যে ওই রাত এতোটা লম্বা হবে!
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্থান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে একযোগে ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় ঢাকায়। পাকিস্থানি বাহিনীর অতর্কিত সেই হামলায় মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে সমগ্র ঢাকা শহর। পৃথিবীবাসী অবাক হয়ে দেখেছে ধর্মের নামে বর্বর হানাদার বাহিনী কিভাবে একরাতে প্রায় অর্ধলক্ষ ঘুমন্ত বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং-এর বর্ণনায় জানা যায়, ২৫ মার্চ ৭১-এ রাত দশটার দিকে শুরু হয় সেই পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ। যদিও পরিকল্পনা অনুযায়ী জিরো আওয়ার বা আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল রাত একটা। মধ্যরাতে ঢাকার পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশলাইন, নীলক্ষেত এলাকায় আক্রমণ চালায় হানাদাররা। ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানার বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করে এবং ইপিআর দফতরের ওয়্যারলেস ব্যবস্থা দখল করে নেয় ২২তম বেলুচ রেজিমেন্ট।
অন্যদিকে ১৮ নং পাঞ্জাব, ৩২ নং পাঞ্জাব ও ২২ নং বেলুচ রেজিমেন্ট ট্যাংক ও মর্টার হামলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের গুলি, ট্যাংক-মর্টারের গোলা আর আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ঘটে নৃশংসতম হত্যার সব থেকে বড় ঘটনাটি।তারা গোলা নিক্ষেপ করে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসে, হামলা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তি এলাকায়। ইতিহাসের এই নির্মম নিধনযজ্ঞ আর তা রাতেই ছড়িয়ে পরে পুরো শহরে। ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়নারা। সেই রাতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে প্রতিরোধ শুরু হয়। ইপিআর সদস্যরাও প্রতিরোধের চেষ্টা করে জীবন দেন। তারপর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নিধনে সামনের সারিতে ছিলেন পাকিস্থানি জেনারেল টিক্কা খান। আর ছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটি। হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকান্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলত বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলংকজনক, জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। পরবর্তী ৯ মাসে ৩০ লক্ষ নিরাপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার মাটিতে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনি তার দোসর জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠনসহ রাজাকার-আলবদর-আলশামস্ বিভিন্নভাবে বাংলার মাটিতে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। পাকিস্থানিদের সাথে ব্যাপক গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সীমাহীন লুটপাটে যুক্ত হয়েছিল তারা। পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সৃষ্টি করেছিল সেই বর্বর ইতিহাস, নিষ্ঠুরতা ও সংখ্যার দিক দিয়ে (ইহুদি হলোকাস্ট ১৯৩৩-৪৫) বা রুয়ান্ডার গণহত্যা (১৯৪৪) কেও অতিক্রম করে গেছে।
মধ্যরাতেই ঢাকা তখন লাশের শহর। দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতেও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্থানি সামরিক জান্তা। পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্থান সরকার প্রকাশিত দলিলেই রয়েছে। পাকিস্থান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়- ‘১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’ চারিদিকে রক্ত আর রক্ত, শহীদদের সারি সারি লাশ। অপারেশন সার্চলাইটকে নিছক বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের একটি সামরিক চেষ্টা মনে করার কোন কারণ নেই। আসলে এটা ছিল এক ভয়াল গণহত্যার নীলনকশা, গোপনে গোপনে যার প্রস্তুতি চলছিল অনেক আগে থেকেই। পাকিস্থানি সামরিক জান্তাদের মনে বাঙালি সব সময়ই ছিল নিচু শ্রেণির, আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি থেকে জীবনাচরণ-সবই ছিল অপাকিস্থানি। অষন্ড পাকিস্থানের নামে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী সেই অপকিস্থানিদের শুদ্ধ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট শুরু করেছিলো। যার ফলে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয় বাংলাদেশে।
মধ্যরাতে পরিচালিত হয় পাকবাহিনীর স্পর্শকাতর অভিযান ‘অপারেশন বিগবার্ড’। গ্রেফতার করা হয় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালির শতবর্ষের দাসত্বমুক্তির অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। ঐ দিন পাকিস্থানিরা আমাদের শুধু হত্যাই করতে চায়নি, আমাদের বাঙালি জাতিসত্তাকে ধংস করার ষড়যন্ত্র নিয়ে তারা অপারেশনে নেমেছিল। জাতিসংঘের ঘোষণায় ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন হয়েছে সেদিন বাঙালির ওপর। ২৬ মার্চ এর প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল। এই সাংবিধানিক ঘোষণা জানালেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু পিপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রেরিত বার্তায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি প্রতি ইঞ্চি জমি পাকিস্থানি হানাদারমুক্ত করার আহ্বান জানালেন। নিরস্ত্র জনগণের গণঅভ্যূত্থান সশস্ত্র গণঅভ্যূত্থানে পরিচালিত হবার সূচনাক্ষণও ছিল এই ২৫ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন-প্রতিরোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পাকসেনাদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসে সেনা ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও। ওই সময়েই বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়, শুরু হয় স্বাধীনতাযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
সেই সময়ের একটি বিশ্বাসঘাতক অংশ সেদিন পাকিস্থানের পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের উত্তরসূরীরা আজও সেই ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। তাদের ভাষায় হানাদার বাহিনি বাঙালির উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। তারা ‘পাকিস্থানি হানাদার বাহিনি’ বলতে নারাজ। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দুঃখ প্রকাশ করে, আর তাদের দোসর পাকিস্থানিরা নিন্দা জানায়। বাঙালির শত্রুরা ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বারবার চেষ্টা করে। পেয়ারে পাকিস্থানের গুণগ্রাহীরা এখনো সদা তৎপর বাংলাদেশে। জাতির ইতিহাস পাল্টে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা তাদের নেই। সঠিক ইতিহাস পাল্টে ফেলার অনেক ইতিহাস রয়েছে পাকিস্থানের খাতায়। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তাই এখনো চলছে নানা ষড়যন্ত্র।
২৫ শে মার্চ আমাদের সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ গুলোর একটি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্ব। এই একটি শব্দে জাতি খুঁজে পায় তার শেকড়ের সন্ধান। বাংলাদেশের ইতিহাস স্মরণ করতে গেলে হাজার বছরের স্বাধীনতার সংগ্রামের বিভিন্ন খন্ডিত ইতিহাস আমাদের কাছে স্মরণযোগ্য। এই সব কিছু ছাপিয়ে ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ মূর্ত করেছে আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতা। আর এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গড়ে উঠেছে আমাদের ভাষার অধিকার ও স্বাধীন স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন থেকে। ২৩ বছরের পাকিস্থানি শাসন থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে অনেক রক্ত ঝরেছে। অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক একটি স্মরণীয় মূহুর্ত।