বাআ ॥ ‘চাপের মুখে পদত্যাগ ঘোষণা, এইমাত্র ভয়ানক দুঃসংবাদ’, ‘শেষ রক্ষা হলো না হাসিনার, এইমাত্র ভয়ানক দুঃসংবাদ’ অথবা ‘নয়া পল্টনে উৎসব, রাজপথে এ্যাকশন, চমক আসছে’- এমন সব শিরোনামে দৈনিক শত শত ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে ইউটিউব চ্যানেলে, যার মূল লক্ষ্যবস্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বর্তমান সরকার। বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে এমন গুজব নির্ভর শত শত ভিডিও দৈনিক তৈরি হলেও ১৭ মার্চ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী দাবি করেন, ‘বিএনপি নেতাদের নিয়ে ডিপ ফেক ভিডিও ছাড়া হচ্ছে’।
রুহুল কবীর রিজভী জানান, বিএনপি মিডিয়া সেল খুঁজে বের করেছে আওয়ামী লীগ বিএনপির নেতাদের নিয়ে গুজব ভিত্তিক ভুয়া ভিডিও তৈরি করছে। এ সময় তিনি দাবি করেন, বিএনপির পক্ষ থেকে কখনও কোন গুজব করা হয়না। কিন্তু বাস্তবতা হলো- আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গুজব হচ্ছে এমন তথ্য দেয়া বিএনপির মিডিয়া সেলের বিরুদ্ধেই তথ্য বিকৃত করে প্রচার ও গুজবের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে বিগত কয়েক বছরে।
গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্লাটফর্মগুলো থেকে কোন গুজব প্রচারিত না হলেও বিএনপির মিডিয়া সেল এবং অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ও টুইটার হ্যান্ডেল থেকে একাধিক গুজব প্রচার করা হয়েছে। আর সেই সঙ্গে বিএনপি সমর্থিত ব্যক্তি ও সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলো থেকে নিয়মিত গুজব প্রচার হচ্ছে। এজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কয়েক হাজার ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ। তবে অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্লাটফর্ম থেকেও বিএনপির গুজব প্রচারের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর ‘চট্টগ্রামে রাউজান উপজেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলা’ এমন ক্যাপশন ব্যবহার করে শেয়ার করা হয় একটি পোস্ট যা সম্পূর্ণ ‘বানোয়াট ও ভিত্তিহীন’ বলে বিবৃতি প্রদান করে রাউজান উপজেলা বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ। রাত ৮টা ৮ মিনিটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে হামলা ও ভাংচুরের বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করে তার ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলা। এ সময় ঘরের আসবাবপত্র ভাংচুর, নারী ও শিশুদের হামলা এবং লুটপাট করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।’ বিএনপির এই পোস্টকে কেন্দ্র করে ২০ তারিখ রাতেই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে রাউজান উপজেলা বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ। সংস্থাটির সভাপতি সুকুমার বড়ুয়া এবং সাধারণ সম্পাদক আংশুমান বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এই বিজ্ঞপ্তির শিরোনাম ছিলো ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি)’র ফেসবুক পেজে প্রকাশিত বানোয়াট ও ভিত্তিহীন স্ট্যাটাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’।
এ ছাড়াও ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি ও পুলিশের সংঘর্ষের পর বিএনপির অফিসিয়াল ভেরিফাইড দুটি ফেসবুক পেজে একাধিক ভিডিও ও ছবি পোস্ট করা হয় যেখানে বলা হয় আর্জেন্টিনার জার্সি পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিএনপির ভেরিফাইড পেজ ‘বিএনপি মিডিয় সেল’ থেকে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় একটি ইউটিউবের লিংক শেয়ার করা হয় যার শিরোনাম ছিলো, ‘বিএনপি নেতাকর্মীদের দিকে প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়ছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।’ এই ভিডিওতে আর্জেন্টিনার জার্সি পরা অবস্থায় একজনকে গুলি করতে দেখা যায়। অপর এক ভিডিওতে আর্জেন্টিনার জার্সি পরা এই আনসার সদস্যকে দেখিয়ে একই পেজ থেকে পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘পুলিশের সাথে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা একত্র হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের দিকে প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।’
এদিকে বিএনপির অফিসিয়াল ভেরিফাইড পেজ থেকে এই আনসার সদস্যের ভিডিও পোস্ট করে লেখা হয়, পুলিশের সাথে সাথে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও হামলা চালিয়েছে বিএনপি নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।’
এদিকে অস্ত্রহাতে আর্জেন্টিনার জার্সি পরা এই ব্যক্তি যে আনসার সদস্য তা খুব দ্রুত গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে প্রকাশ পায়। ভুল এই তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার পর সঠিক তথ্য পেলেও বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেনি বিএনপি।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ‘আমদানি-রফতানি নিষেধাজ্ঞা’ নিয়েও গুজব প্রচারিত হয় বিএনপির মিডিয়া সেল নামক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্লাটফর্ম থেকে। অন্যদিকে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ‘খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে’ বা ‘তারেক রহমানের নির্দেশে ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে’ এমন বক্তব্য একাধিক সিনিয়র নেতার বক্তব্যে উঠে আসে। যদিও এর কোন কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।
বিএনপির অফিসিয়াল বক্তব্য ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্লাটফর্ম থেকে প্রচার হওয়ার এ ধরণের গুজবের বিষয়টি নতুন নয়। দলটি তার ভেরিফাইড প্লাটফর্মগুলো থেকে এ ধরণের একাধিক ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে। পদ্মাসেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে মহামারী করোনাকালেও এই পেজগুলো থেকে ছড়ানো হয়েছিলো বিভ্রান্তিকর তথ্য। করোনা টিকার অভাবে দেশে মৃত্যুহার বাড়বে বলেও জানায় দলটি। এ ছাড়াও দেশে গুম নিয়েও ২০১৩ সালে বিতর্কিত এক তালিকা প্রদান করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন দলটির শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। সম্প্রতি সময়ে দলটির সবচাইতে বড় মিথ্যাচারের একটি উদাহরণ ছিলো সংবাদ সম্মেলন করে একজনকে সাংবাদিকদের সামনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া। আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্লাটফর্মগুলো থেকে এ ধরণের একটিও মিথ্যা বা গুজবের বিষয়টি উল্লেখ করতে না পারলেও রিজভীর দাবি ‘আওয়ামী লীগ ডিপ ফেক ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে বিএনপির সিনিয়র নেতৃত্বের নামে’।