প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ বাংলাদেশ ইস্যুতে আমেরিকার হস্তক্ষেপ বা অতি-সক্রিয়তাকে ভারত যে মোটেই পছন্দ করছে না, বাইডেন প্রশাসনের কাছে দিল্লি এটা স্পষ্ট করে দেওয়ার পরেই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে কার্যত আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছিল! গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বিকালে দিল্লির থিংক ট্যাংক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে’ (ওআরএফ) নিজের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এমনই মন্তব্য করলেন ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ ও ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী। ‘ট্রান্সফর্মেশন: ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ অ্যান্ড ইভোলিইশন অব ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ টাইজ’ নামে তার লেখা এই বইটি সদ্যই প্রকাশিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে একটি প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ভারতের পক্ষ থেকে তখন এই কড়া বার্তাটা (আমেরিকাকে) শুনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার পরিণতিতে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত, যিনি তার কিছুদিন আগেও অমুক বিএনপি নেতাকে দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে ডেকে আনছিলেন বা তমুক বিএনপি নেতার বাসায় গিয়ে হাজির হচ্ছিলেন- তাকে আর ভোটের সময় দেখাই গেলো না! কোথায় যে তিনি গা ঢাকা দিলেন সে তিনিই জানেন!’
গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলা যায় কি না, এমন একটি প্রশ্নেও তিনি ঘুরিয়ে জবাব দেন- কোনও দল যদি নিজেদের সিদ্ধান্তে নির্বাচনে না অংশ নেয়, তাহলে তার জন্য বিজয়ী দলকে দোষারোপ করা সাজে না।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের ভারতেও হামেশাই দেখা যায় যে দল জানে তারা ভোটে হারবে তারা অনেক আগে থেকে বলতে শুরু করে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্র) কারচুপি করা হচ্ছে। কাজেই তাদের অজুহাতের অভাব হয় না।’
অনুষ্ঠানে অন্যতম আলোচক, আর একজন সাবেক ভারতীয় কূটনীতিবিদ ও ঢাকাতে প্রাক্তন হাই কমিশনার ভিনা সিক্রি বলেন, তার মূল্যায়ন হলো আমেরিকা আসলে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে একটি ‘মডারেট’ (মধ্যপন্থী) ইসলামপন্থী দল হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের কোনও ধারণাই নেই যে জামায়াতের চিন্তা-চেতনা ও কর্মকান্ড কতটা উগ্রবাদী। ভিনা সিক্রি মনে করেন, এই ‘ভুল ধারণা’র ভিত্তিতেই জামায়াত ও তাদের রাজনৈতিক সঙ্গী বিএনপি আমেরিকার কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে আসছে।
এই প্রসঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, তিনি মনে করেন আমেরিকাও আসলে জানে জামায়াতের প্রকৃত রূপটা কী। কিন্তু সেই একাত্তর থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে বিদ্বেষমূলক একটা মনোভাব ছিল, তার প্রতিফলন আজও রয়ে গেছে। এই কারণেই ওয়াশিংটন আজ অর্ধশতাব্দী বাদেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের তোল্লাই দিয়ে যাচ্ছে।
এদিনের আলোচনায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং ওআরএফ কলকাতার পরিচালক অনুসূয়া বসুরায় চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন ওআরএফ দিল্লির সিনিয়র ফেলো তথা স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষক সুশান্ত সারিন।
ইউরোপের বেলগ্রেড থেকে অনলাইনে আলোচনায় অংশ নেওয়া শহীদুল হক বইটির একটি অংশ থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের ‘নিয়তি যে এক সূত্রে গাঁথা’ এই কথাটি তিনিও অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করেন। দুই দেশের সম্পর্ককে ‘চিরায়ত বন্ধুত্বের’ (ইটারনাল ফ্রেন্ডশিপ) সম্পর্ক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, এটি যে আসলে ‘স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কেরও ঊর্ধ্বে’-তা ২০১৫ সালে ঢাকা ও দিল্লির যৌথ বিবৃতিতেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, আজ বাস্তবেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
তবে সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, ‘আমাদের দুই দেশের পরস্পরকে কিন্তু বুঝতে হবে যথাযথ অনুভূতি (সেন্টিমেন্ট) আর মর্যাদা (রেসপেক্ট) দিয়ে। বাঙালিরা এমনিতেই খুব সেন্টিমেন্টাল (অনুভূতিপ্রবণ) জাতি, সেটা (নীতিনির্ধারকদের) মাথায় রাখতে হবে।’
অনুসূয়া বসুরায় চৌধুরী বাংলাদেশে কথিত ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার প্রসঙ্গ অবতারণা করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে প্রকাশ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই আন্দোলনের কোনও ভিত্তি নেই এবং এটা নিয়ে চিন্তারও কিছু নেই, সেটা অত্যন্ত বলিষ্ঠ একটা পদক্ষেপ।’ এই তথাকথিত ক্যাম্পেইন যে সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু জনভিত্তিহীন অ্যাক্টিভিস্টের কারসাজি, সেটাও উল্লেখ করেন তিনি। সঞ্চালক সুশান্ত সারিন এই সময় হালকা চালে মন্তব্য করেন, সোশ্যাল মিডিয়াকে এখানে গুরুত্ব দেওয়াটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।
ভারতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘অতি স্পর্শকাতর কৃষিপণ্য’ পেঁয়াজের রফতানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও রোজার মাসে শুধু বাংলাদেশকে যে ভারত তা থেকে ছাড় দিয়েছে, সেই ‘অনিয়ন ডিপ্লোমেসি’র পদক্ষেপকেও স্বাগত জানান অনুসূয়া বসুরায় চৌধুরী।
পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর বইতে ‘ভেক্সড ইস্যুজ’ নামে একটি চ্যাপ্টারে দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। সেরকমই একটি নিষ্পত্তি না-হওয়া ইস্যু, তিস্তা চুক্তি-র প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ভিনা সিক্রি বলেন, ‘আমার মতে দুই দেশ তিস্তার উৎস থেকে শুরু করে যৌথভাবে হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে করলেই কেবল এই সংকটের সমাধানের ফর্মুলা বেরোতে পারে। কারণ যে কোনও চুক্তি করার আগে তিস্তায় কখন কতটা পরিমাণ জল থাকে, সেটা জানা খুব জরুরি। অথচ তিস্তার ক্ষেত্রে সেই তথ্যটাই আমাদের হাতে নেই।’