প্রশান্তি ডেক্স ॥ ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে জমজমাট কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের জুতা শিল্প। এবার বিক্রি হতে পারে প্রায় ২০০ কোটি টাকার জুতা। রমজানের শুরু থেকেই ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার জুতা তৈরির ২ হাজারের বেশি কারখানার লাখো শ্রমিক। স্বাধীনতার আগে শুরু হওয়া ভৈরবের জুতা তৈরির বাজার, এখন সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। সারা বছর কম-বেশি কাজ থাকলেও ঈদ এলেই কারখানায় শ্রমিকদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বছরের এই সময়টাকে ব্যবসার প্রধান মৌসুম মনে করেন তারা। জুতা তৈরিতে আমদানি করা কাঁচামালের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়তে পারে জুতাশিল্পে। এসব নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন এখানকার কারখানা মালিক ও শ্রমিকরা।
ভৈরবে তৈরি জুতার সুনাম রয়েছে পুরো দেশে। তাইতো দেশের নানা প্রান্ত থেকে পাইকাররা ভিড় করছেন ভৈরবের জুতার মার্কেটগুলোতে। গুণগতমান, টেকসই ও দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ায় ভৈরবের জুতা এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের বাজারেও রফতানি হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার কার্টুন জুতা রেল, সড়ক ও নৌপথে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে ছোট-বড় কারখানাগুলোতে চলছে বিরতিহীন ব্যস্ততা। প্রায় দুই হাজার জুতা কারখানায় লক্ষাধিক শ্রমিক দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। কারখানাগুলোতে চলছে শিশু ও নারী-পুরুষের জন্য রঙ-বেরঙের বাহারি এবং আধুনিক ডিজাইনের জুতা তৈরির কাজ।
জুতা বানাতে ডিজাইন, সোল, সেলাই, কাটিং, পেস্টিং, রঙ, সলিউশন ও আপার তৈরির মতো বিভিন্ন কাজ করতে হয়। প্রতিটি কাজের ধরণ অনুযায়ী জুতা তৈরির কারিগররা কারখানাগুলোতে কাজ করেন। কাজের প্রকারভেদে কারিগররা ডজন হিসেবে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। তবে শ্রম ও কাজ অনুযায়ী, শ্রমমূল্য নিয়ে খুশি নন এখানকার কারিগররা।
ভৈরবের লক্ষ্মীপুর এলাকার সোহরাব মিয়া ও জগন্নাথপুর এলাকার আবু কালাম। বাপ-দাদার সূত্র ধরেই শিখেছেন জুতা তৈরির কাজ। এ কাজের রোজগার থেকেই চলে তাদের পরিবার। কিন্তু এখন আর জুতা তৈরিতে তেমন রোজগার হচ্ছে না। তারা জানান, যে হারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তাতে করে আমাদের রোজগার তো বাড়ছে না। তাই আমরা আর এ কাজ করে টিকতে পারছি না। তাই আমরা এ পেশার ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত।
জুতা তৈরিকে ঘিরে ভৈরবে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার কারখানা রয়েছে। যেখানে কাজ করছেন লাখেরও বেশি জুতা তৈরির কারিগর। যার যেমন পুঁজি, তার তেমনি ব্যবসার ধরণ। কেউ কেউ আবার বংশানুক্রমে এ ব্যবসায় জড়িত।
মো. আলী হোসেন, মো. শরীফ ও বাবুল বাইদ বিভিন্ন ছোট-বড় কারখানার মালিক। তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে রমজান এলেই ঈদকে কেন্দ্র করে এখানকার জুতার ব্যবসা জমজমাট হয়। বছরের বাকি সময় ব্যবসা কম হওয়ার কারণ হিসেবে তারা জুতা তৈরিতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বাড়ার কথা বলছেন। জুতা তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম যদি না কমে এভাবে বাড়তেই থাকে, তাহলে এখানকার জুতা শিল্পটি হুমকির মুখে পড়ে যাবে।
এদিকে ভৈরবের জুতা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ছোট-বড় প্রায় ৫/৬শ কাঁচামালের দোকান গড়ে উঠেছে। জুতা তৈরিতে যেসব উপকরণের প্রয়োজন হয়, বিভিন্ন কারখানায় তারা সেসব বিক্রি করেন। তবে বর্তমানে তারাও রয়েছে বিপাকে।
এসব কাঁচামালের ব্যবসায়ীরা জানান, জুতা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ ভারত, চীন ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করতে হয়। আমদানি মূল্য বেশি হওয়ায় এসব উপকরণ বেশি দামেই বিক্রি করতে হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ক্ষুদ্র কারখানাগুলোতে। যে কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জুতা তৈরি করছে কম। আর তাদেরও জুতা তৈরির উপকরণ বিক্রি হচ্ছে কম। যদি জুতা তৈরি না হয়, তাহলে কারিগররাও রোজগার করতে পারবে না।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকাররা জানান, যাতায়াত ও পরিবহণ সুবিধা থাকায় ভৈরবের জুতার কদর প্রায় ষাট বছর ধরে। এছাড়াও ভৈরবের জুতা ডিজাইন, গুণগত মান ও দামে সাশ্রয়ী। তাইতো এখানকার জুতা কিনে পাইকাররা দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করছে। এই জুতা শিল্পটি বিস্তারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানান পাইকাররা। ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আল আমিন জানান, কারখানার দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ জুতা শিল্প এলাকা ভৈরব। পাইকারি বাজার হিসেবে রাজধানী ঢাকার পরেই ভৈরব। ধীরে ধীরে জুতা তৈরির শিল্পটি বিরাট আকার ধারণ করছে। তাই সরকার যদি ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এ শিল্পে আরও বেশি ভূমিকা রাখবে। সরকার যদি এই শিল্পে সুনজর দেয়, তাহলে পোশাক খাতের মতো পাদুকা শিল্পও দেশের অর্থনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। জুতা তৈরির এই শিল্পের উন্নতিতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।