প্রশান্তি ডেক্স ॥ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দেওয়া সংক্রান্ত রিট আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রশ্ন উঠেছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে আদৌ করারোপ করা যায় কিনা? এ সিদ্ধান্তের পরিণতি কী হতে চলেছে? এসব নিয়ে কথা হয় শিক্ষক, গবেষক ও লেখক সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে।
প্রশ্ন: সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর করারোপ নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি সেটা নিয়ে আলাপ করতে চাই। আমরা জানি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে করারোপের সুযোগ আছে কিনা?
উত্তর: এটা সম্প্রতি নয়, গত ২০ বছর ধরেই এই আলোচনা আছে। সরকার যে আইন করেছে, ২০০৭ থেকে যদি শুরু করি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বাংলাদেশে বেশি দিনের নয়, ৩০/৩২ বছর। তার মধ্যে অর্ধেক সময় কেটেছে এই বিতর্কে। কিন্তু সে বিষয়ে এখনও নিষ্পত্তি হয়নি, আলোচনা চলমান। আমরা দুইভাবে আলোচনা করতে পারি। একটা হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। অর্থাৎ এগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু এগুলোর পরিচালনা বেসরকারিভাবে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় তো আসলে বেসরকারি হয় না। এটাকে আধাসরকারি বলতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রপতি এখানকার চ্যান্সেলর এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এগুলোকে পরিচালনা করেন। সবসময় তারা তাদের নখদর্পণে রেখেছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ও অধ্যাপক সবার বেতন তারা যা আয় করেন তা দিয়েই থাকেন। সেদিক থেকে এটা সম্পূর্ণ করমুক্ত নয়। এখন প্রশ্ন হলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে, করপোরেশন হিসেবে এর আইনগত মর্যাদা কী। এটা ট্রাস্ট এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তাহলে এখানে কর প্রয়োগের যৌক্তিকতা দুরকম হতে পারে। সরকারের ভীষণ অর্থাভাব। সুতরাং, যেকোনও জায়গা থেকে করারোপ করে পয়সা নিতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের যে রাজস্বনীতি, সেখানে বিদেশিদের একটা চাপ আছে। চাপটা হচ্ছে, কর এবং অন্যান্য সংগ্রহ বাড়াতে হবে। তবে সেটার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চাপ দেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু আমি মনে করি না। এটা যেহেতু আরও আগে থেকে শুরু হয়েছে, তাতে যৌক্তিকতাটা কী? আমরা যদি সেটা খুঁজতে যাই, তাহলে এর মধ্যে কোনও যৌক্তিকতার নিদর্শনই দেখা যায় না।
শিক্ষার একটা বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে দেশে। সেই চাহিদার অর্ধেকও আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মেটাতে পারেনি। সে কারণে গত ৩০/৩২ বছর ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ হচ্ছে। এখন সরকারের এই করারোপ নীতিটা এই শিক্ষা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে। এটাই প্রশ্ন আমাদের। সাধারণত দেখা যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক বেশি সাহায্য সরকার করেন। সরকারি সাহায্য ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলবে না। তাদের নিজেদের আয় দিয়ে চলে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের আয় দিয়ে চলে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার যে পরিমাণ করই আরোপ করুক না কেন, সেটা শেষ বিচারে ছাত্রদের দিতে হবে। এবং ছাত্ররা দিতে গিয়ে যারা অসমর্থ হবেন, ওই প্রান্তীয় পয়সাটা দিতে না পেরে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করবেন। কাজেই শিক্ষা সম্প্রসারিত না হয়ে সংকুচিত হবে। এখন আইনে যাওয়ার আগে আমাদের নীতিগত প্রশ্ন হচ্ছে এইটা আমরা কি শিক্ষা বিশেষত উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ চাই, নাকি সংকোচন চাই? সরকারের এই করারোপ নীতিটা সরকারের রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে হয়তো খানিকটা সহায়ক হবে, কিন্তু এটা শিক্ষাকে, যেটা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ধরে নিতে হবে, সেটা সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন: সেটা তো গেলো শিক্ষার্থীদের ক্ষতির জায়গা, এই করারোপের ফলে প্রতিষ্ঠান কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
উত্তর: আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন আছে। এখানে তাদের নির্দেশ দেওয়া আছে কীভাবে তারা অর্থ ব্যয় করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটাকে বলে উন্নয়ন কাজ, সেখানে তাকে ব্যবহার করতে হবে। এবং অন্য কাজে এই অর্থ ব্যবহার করা যাবে না। আইনগত প্রশ্ন দেখা দেবে সামনে, সেটা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যয় বলতে যা বোঝানো হয়, তার মধ্যে আয়কর দেওয়াটা পড়ে কিনা। সেটা নিষ্পত্তি আমি করতে পারবো না। সেটা আদালতে ব্যাখ্যা দিতে পারেন, এমনকি জাতীয় সংসদের হস্তক্ষেপেরও প্রয়োজন হতে পারে। যদি প্রয়োজনীয় ব্যয় বলতে বোঝায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণ, পরিবহন ব্যবস্থা করা, দালানকোঠা তৈরি, ল্যাবরেটরি তৈরি, লাইব্রেরি করা, আরেকটি আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যদিনের ব্যয়। যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে শতকরা ১৫ ভাগ নতুন করে কর দিতে হয়, তবে সে ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধি করবে। অথবা যেটা সম্ভব নয়, কর্মচারী যারা অতি অল্প বেতনে চাকরি করেন তাদের সংখ্যা কমাতে হবে। যেদিক থেকেই করেন না কেন ছাত্রদের বেতন বাড়ানো, অথবা কর্মচারী-শিক্ষকদের বেতন কমানো, এভাবেই মালিকেরা করবেন। তাতে ক্ষতি হবে কার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি হবে। যে উদ্যোক্তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাদের ওপর করারোপ করা হচ্ছে এরকম একটা অনুভূতি আছে, কিন্তু এ অনুভূতি সত্য নয়। এটা শেষ পর্যন্ত যাবে অভিভাবকদের ওপর। সেক্ষেত্রে যেটা হবে প্রতিষ্ঠান ছাত্র হারাবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানের মূলধন তো ছাত্র। সেদিক থেকে আমি মনে করি, করারোপের সিদ্ধান্তটা জাতীয় নীতির দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত নয়। আমি যদি ধরে নিই জাতীয় নীতি হচ্ছে দেশের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো।
দেশ থেকে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে যেন না চলে যায়, সেজন্যই কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাজ করছে। আরও একটি অদৃশ্য দিক আছে বিদেশে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত যেসব গবেষক-শিক্ষক আছেন, তারা দেশে ফিরতে চান অনেক সময়, আমার নিজের অভিজ্ঞতায় আমি জানি। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝখান থেকে ঢোকার সুযোগ একেবারেই নেই। আপনাকে ঢুকতে হবে প্রভাষক আকারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে আমি মনে করি, আমাদের অনেক মেধাপাচার বন্ধ হয়েছে। আর্থিক সামর্থ্য অনুসারে ছেলেমেয়েদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে, অথবা যেসব গবেষক দেশে ফিরে আসতে চাইতেন, তাদের মধ্যে ফিরে আসার প্রবণতা একটু হলেও মন্দাক্রান্ত হবে।
প্রশ্ন: এই যে এত বিষয় আমরা আলাপে বের করতে পারছি কোন কোন জায়গাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে যারা নীতিনির্ধারক তারা কি এই বিবেচনাগুলো না করে হঠাৎ আরোপে গেলো?
উত্তর: আমি আবারও বলছি, এটা হঠাৎ নয়। অনেক দিন ধরেই এ চিন্তাটা হচ্ছে। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি কী, এই বিষয়ে আমাদের দেশে অনিশ্চয়তা, দোদুল্যমানতা ভবিষ্যৎ দৃষ্টির অভাব আছে। পৃথিবীর যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয়েছে, তারা কিন্তু একদিনে হয়নি। আমরা জাপানের কথা আলোচনা করতে পারি। সেই ১৮৬০-এর দশকে জাপান যে অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে আসছে, ১৯৬০-এও জাপানকে উন্নয়নশীল দেশ বলা হতো। এখন যে সে পাশ্চাত্যের চেয়েও জীবনমান উন্নত করেছে, তার পেছনে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আছে। একটা বিনিয়োগের ক্ষেত্র হচ্ছে টেকনোলজি। জাপান কিন্তু টেকনোলজি যত উদ্ভাবন করেনি, তার চেয়ে বেশি আমদানি করেছে এবং কাজে লাগিয়েছে। এগুলো প্রয়োগ করেছে। এজন্য আমরা বলি ইমিটেশন টেকনোলজি। কিন্তু একটা জিনিসে সে ইমিটেশন করেনি। সেটা হচ্ছে তার শিক্ষাব্যবস্থা। জাপান তার নিজের ভাষা ছাড়েনি। কিন্তু ইংরেজি ফরাসি জার্মান রুশ এই চার ভাষাতেই দেশকে শিক্ষিত করে তুলেছে। ফলে জাপান দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষায় বিনিয়োগ করার কারণে তার যে আমলাতন্ত্র, আরেকদিকে বেসরকারি আমলাতন্ত্র দুটি উন্নত হয়েছে। আমাদের দেশে এরকম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনাকারীর অভাব আছে। এটা সরকারের ভেতরে ও বাইরেও। আপনি উন্নত দেশ হতে পারবেন না, যদি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন না আনেন। মৌলিক পরিবর্তন মানে হলো আপনি যদি নতুন টেকনোলজি উদ্ভাবন নাও করতে পারেন, টেকনোলজি এনে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের এখানে মেশিন যখন ভেঙে পড়ে, তার পার্টস তৈরি করতে পারি না। এটা ঠিক করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার বিদেশ থেকে আনতে হয়। এ অবস্থা যদি থাকে তাহলে আপনার দেশ সত্যিকার অর্থে শিল্পায়িত হবে না। এটা হবে অন্যের শিল্পের জোগানদার, যেটা আমাদের বর্তমান অর্থনীতিতে আছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি শক্ত করতে চাই, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দরকার। সরকারের এই করনীতি মনে হতে পারে, সরকারের স্বল্প সময়ে আয় বৃদ্ধি করবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা সরকারের বিনিয়োগে উৎসাহ কেড়ে নেওয়ার মতো। আমাদের নৈতিক দিক থেকে দেখলে এটা সমর্থনযোগ্য নয়, বরং পুনর্বিবেচনার অবকাশ আছে।
প্রশ্ন: কেমন পুনর্বিবেচনা হতে পারে?
উত্তর: বর্তমানে যে হারে করারোপের কথা বলা হচ্ছে, সেটা ইচ্ছে করলেই সরকার কমাতে পারেন। বিদেশিদের ব্যবসা করার জন্য ইপিজেড করতে দেই। কর রেয়াত দেন, ট্যাক্স হলিডে বলে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আপনি কর রেয়াত দিতে পারেন। এনবিআর হঠাৎ করে রমজানের আগে কতগুলোর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে এবং বলা হচ্ছে ২০০৭ থেকে তাদের না দেওয়া কর দিতে হবে। আমার মনে হয়, এসব ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার অবকাশ আছে।
প্রশ্ন: আলাপ-আলোচনার বিষয়েই আসি যেহেতু দুপক্ষই আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। সেখানে গণমাধ্যমে অ্যাটর্নি জেনারেলের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এবং এখন থেকে কর দিতে হবে। অথচ নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। এই ভুল বোঝাবুঝির জায়গা কীভাবে তৈরি হলো?
উত্তর: বিষয়টির মূল তথ্যগুলো জানা দরকার। আমরা যতটুকু দেখলাম, উচ্চ আদালত একটি রায় দিয়েছিলেন ২০২১ সালের দিকে। সেটাতে বলা হয়, এই করারোপ বৈধ নয়। এখন সরকার আপিল করেছেন। সেই আপিল উচ্চ আদালতের উচ্চতম যে শাখা আপিল বিভাগ, ঠিক গ্রহণও করেননি, বলেছেন নিষ্পত্তি করো। এবং তারা যে সংক্ষিপ্ত মৌখিক আদেশ দিয়েছেন সেটার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, নিষ্পত্তির দাবি আছে বটে। পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায় না পাওয়া পর্যন্ত বলতে পারবো না কী কী শর্ত সেখানে আছে।
নিষ্পত্তিটা কীভাবে হতে পারে? পুরনো ট্যাক্স মওকুফ করে দেন। ১৫ শতাংশ না করে কমিয়ে আনেন। একটা কথা পরিষ্কার যে ট্যাক্স দিতে হবে। আপিল বিভাগ সেটা বাতিল করেননি। তারা মনে করেন, ট্যাক্স দিতে হবে না এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তার বিকল্প কী হবে সেটা নির্ধারণের সুযোগ আছে। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের বরাত দিয়ে মিডিয়ায় যা বলা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ কথা নয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে হাফ ট্রুথ আনট্রুথের চেয়ে খারাপ। প্রশ্ন হচ্ছে, ঈদের আগে ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা, এটা সাময়িক অসুবিধা সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ বেতন দিতে পারেননি। জবরদস্তি করার কোনও প্রয়োজন নেই। এটা তো আলোচনার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় এমন কোনও জায়গা নয় যে সে পালিয়ে যেতে পারবে। এটা এমন নয় যে কেউ বিদেশ গিয়ে আর আসবে না। এটা যেহেতু সরকারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন। আমরা সেটার আশায় থাকবো।
প্রশ্ন: বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি এ ধরনের করারোপ করার বিষয়গুলো আছে, নাকি অন্য ধরনের সুযোগ-সুবিধা বেশি দেওয়া হয়?
উত্তর: প্রত্যেকটি দেশের সুনির্দিষ্ট আইন আছে। আমি আমাদের দেশের কথা বলি। আমাদের দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয় ১৯১২ সালের দিকে। তখন সবাই জানেন, ১৯০৫ সনে বঙ্গভঙ্গ করে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশ যে করা হয়েছিল, এটা ১৯১১ সালের শেষে বাতিল করা হয়। সেটার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তারা ঢাকায় রাজধানী না করে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়। তখন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাঁচ লাখ করে বার্ষিক অনুদান দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হতে আরও ৯-১০ বছর দেরি হওয়ায় ১৯২১ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তখন ৫৫ লাখ টাকা মতান্তরে ৬০ লাখ টাকা জমা হয়েছিল। ওই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কত টাকা দিতো সরকার? আমি যা জেনেছি, বছরে আড়াই লাখ টাকা করে দিতো। এটা একটা কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরা ঈর্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে বিরোধিতা করতে চেয়েছিল। পার্থক্য ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অ্যাফিলিয়েটিং ইউনিভার্সিটি, বোর্ডের মতো। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে করা হয়েছিল রেসিডেন্সিয়াল ইউনিভার্সিটি। আমার বক্তব্য হলো সরকারি সাহায্য ছাড়া আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব ছিল না। কিছু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিও তখন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছেন শান্তিনিকেতনে বিশ্ববিদ্যালয়। এজন্য নানা ধরনের ইতিহাস যদি ঘেঁটে দেখি দেখবো যে যেকোনও দেশে সরকার থেকে সাহায্য আসে। এখন উন্নত দেশ বলতে আমরা যেটা বোঝাচ্ছি, যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে কীভাবে। সেখানে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলোর আমরা নাম জানি হার্ভার্ড; কলোম্বিয়া এগুলো বড় বড় অর্থদাতাদের দানে হয়েছে। কিন্তু তাতে যথেষ্ট হচ্ছে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যেসব সৈনিক প্রাণ দিতে গিয়েছিল, তারা ফিরে এসে বলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। তখন আমেরিকাতে অজস্র কলেজ হয়েছে যেগুলো স্টেট ইউনিভার্সিটি। যেমন- নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের কথা জানি, যার ১২টি স্টেট ইউনিভার্সিটি আছে। সবগুলো সরকারি টাকায় চলে। আমরা যেসবকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলি যাদের সম্মানিত বলা হয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে কম সম্মান করে। আমেরিকায় এর উল্টো। হার্ভার্ড, কলোম্বিয়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ডের যে বিনিয়োগ, তা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। সেগুলো আসছে লোকের দান থেকে। আমাদের দেশে সেরকম সুনির্দিষ্ট নীতি থাকলে সরকারও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাহায্য করতে পারে। কারণ, পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে সরকার টাকা দিচ্ছে কী জন্যে? দেশের শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করবার জন্যে। তাহলে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভূমিকা পালন করছে বলে ইউজিসি বলছেন। তাহলে একটা যুক্তি দাঁড় করাতে পারি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রদের বেতন ভাতা দিয়ে চলে। বেতন কম করার জন্য সরকার যদি তাদের অনুদান দেন, তাহলে ছাত্র বেতন কমানো যায়। মোট ছাত্র বেতনের অর্ধেক যদি সরকার দেয়, তাহলে ছাত্র বেতন অর্ধেক হয়ে যাবে। এবং অর্ধেক হয়ে গেলে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এতে উভয়েরই সম্প্রসারণ হবে। এজন্য আমি বলবো ভেবে দেখতে। করারোপের আগে সরকারেরও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। এক ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়কে করারোপ করছি, আরেক ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে করছি না এটা তো বৈষম্যমূলক। সেটা বাদ দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি বিশ্বাস না করেন, তাহলে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফিন্যান্স চলে এটা অডিট রেগুলেশন ইউজিসির বাইরেও অন্য সংস্থা নিয়োগ করতে পারেন। মূল কথা হলো, সরকারের উচিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও আর্থিক অনুদান দেওয়া। যেমন- তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে থাকেন। তার ফল হবে, ছাত্র বেতন কমানো সম্ভব হবে। শিক্ষকদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, যেমন- শিক্ষকদের বাসস্থানের সুবিধা নেই, সেগুলো বাড়ানো যেতে পারে। নির্দিষ্ট প্রকল্প করে উন্নয়নকাজে সরকার টাকা দিতে পারে। সরকার যদি বলেন, না উন্নয়নে দেবো না, ছাত্র বেতনে দেবো ইত্যাদি করা যেতে পারে।