প্রশান্তি ডেক্স ॥ খুলনায় ২০১৫ সালে পৈশাচিক নির্যাতনের জেরে রাকিব নামে ১৩ বছরের এক শিশু মারা যায়। সে সময় নেট দুনিয়ায় তোলপাড় হয়েছিল- এতটুকু শিশু গ্যারেজে কাজ করে! রাকিবের মলদ্বার দিয়ে কমপ্রেসার মেশিনের মাধ্যমে বাতাস ঢোকালে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি।
সেই ঘটনার ৯ বছর পরে আবারও খবরের শিরোনাম হলো আরেক রাকিব। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা দক্ষিণ বাজারে ‘জামাল হোন্ডা গ্যারেজে’ রাকিব নামের এক শিশুকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। ২৭ এপ্রিল গ্যারেজে যেতে দেরি হওয়ায় তাকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে তার মা অভিযোগ করেন।
এরইমধ্যে গ্যারেজে কাজ করা আরও ২১টি শিশু নির্যাতন ও হত্যার খবর নানা সময়ে পত্রিকার পাতায় দেখা গেছে। তবু আমাদের বিস্ময় কাটে না- এত ছোট শিশুরা গ্যারেজে কাজ করে!
সব বিস্ময় কাটিয়ে রাজধানীর ৬০ ফিটের (আগারগাঁও) গ্যারেজের কর্মী ১২ বছরের মমিনুল বলে, ‘আমিতো দুই বছর ধরে গ্যারেজে কাজ করি। নিজে একটা গ্যারেজ দেবো। কাজ শিখছি।’ কত ঘণ্টা কাজ করা লাগে জানতে চাইলে একটু বিরক্ত হয়েই বলে ‘কাজে যতক্ষণ লাগে। এই ধরেন ১২ ঘণ্টা।’
জাতিসংঘের শিশু সনদ অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচের ছেলে-মেয়েদের শিশু বলা হয়। বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শিশুর বয়স ১৪ বছর পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে। শিশুশ্রম সেই সব ছেলে-মেয়েদের কাজ করাকে বোঝায় যাদের পরিপূর্ণ শারীরিক বিকাশ হয়নি। আইন বলছে, তাদের শিশুশ্রমে নেওয়া যাবে না। আর ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে কাউকেই যুক্ত করার সুযোগ নেই।
যদিও অভাব-অনটন ও পারিবারিক চাপের মুখে পড়ে শ্রমের বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে দেশের হাজার হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ। বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন ওয়েল্ডিং কারখানা, মোটরসাইকেল গ্যারেজে প্রতিনিয়ত এসব শিশু শ্রমিকের মুখ দেখা যায়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) দেশে তার নিজস্ব প্যাটার্নে এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ জরিপে পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে নিযুক্ত ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের একটি জাতীয় প্রাক্কলন মূল্যায়ন করা হয়েছে। জরিপের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৫ মে পর্যন্ত পরিচালিত হয়। জরিপের প্রতিবেদনে নির্বাচিত পাঁচটি সেক্টরে নিয়োজিত শিশুদের কাজের প্রকৃতি এবং শিশুদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
বিবিএস বলছে, বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩টি খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এরমধ্যে যে পাঁচটি খাতে ‘শিশুশ্রম জরিপ-২০২৩’ পরিচালনা করা হয়েছে- তারমধ্যে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে সবচেয়ে বেশি ২৪ হাজার ৯২৩টি শিশু কাজ করে।
জরিপ বলছে, পাঁচ খাতে শ্রমজীবী মোট শিশুর সংখ্যা হলো যথাক্রমে: শুটকি মাছ উৎপাদনে ৮৯৮ জন, চামড়ার তৈরি পাদুকা শিল্পে ৫ হাজার ২৮১ জন, ওয়েল্ডিং বা গ্যাস বার্নার ম্যাকানিকের কাজে ৪ হাজার ৯৯ জন, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে ২৪ হাজার ৯২৩ এবং অনানুষ্ঠানিক ও স্থানীয় টেইলারিং বা পোশাক খাতে ২ হাজার ৮০৫ জন। এ থেকে স্পষ্ট যে, পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ খাতের মধ্যে শ্রমজীবী শিশুদের সবচেয়ে বড় অংশ নিয়োজিত রয়েছে অটোমোবাইল খাতে।
শিশুশ্রম গ্রামে বেশি: এদিকে জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুসারে, দেশে ৫-১৭ বছর বয়সী ৩.৫৪ মিলিয়ন (৩৫ লাখ ৪০ হাজার) শ্রমজীবী শিশু রয়েছে। এর মধ্যে ১.০৭ মিলিয়ন ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম রয়েছে। পল্লী এলাকায় শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ২.৭৩ মিলিয়ন এবং শহরাঞ্চলে ০.৮১ মিলিয়ন।
১২ ঘণ্টা কাজ করার প্রশ্নে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একাধিক গ্যারেজে গিয়ে জানতে চাইলে কর্মরত শিশুদের সহযোগীরা বলেন, তারা নিজেরাও এরকম কাজ করে বড় হয়েছেন। ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হলে, কাজ শিখতে হলে সময় দিতে হবে। গ্যারেজ মালিক কবিরের গ্যারেজে কাজ করে তিন শিশুরা যাদের বয়স ১১ থেকে ১৩ বছর। এরা মূলত চা আনা, বিতরণ, মোটরবাইক ধোয়ামোছা, গ্যারেজের নানা ফুটফরমায়েশ খাটে। কত টাকা দেন প্রশ্নে গ্যারেজ মালিক কবির বলেন, ‘ওদের দেখে শুনে কাজ শিখিয়ে বড় করছি।’ হাসতে হাসতে বলেন, ‘ওদের দায়িত্বতো আমারই।’ মাসে বা দিনে কত টাকা দেন, আবারও এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওদের বাবা-মা দেখে রাখতে বলেছেন, কিছু চান না। তারপরেও ঈদে ৫০০ টাকা করে দিয়েছি। এছাড়া কাজ করাতে আসা লোকজন দু’-দশ টাকা দেয় খুশি হয়ে।’
দীর্ঘদিন দেশি-বিদেশি সংস্থায় শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন আব্দুল্লা আল মামুন। তিনি বলেন, ‘আমাদের শিশুরা ৭৭ ভাগই অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে যুক্ত। তবে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে বেশি। কারণ, এসব গ্যারেজ শিশুদের বাসার আশেপাশে গড়ে উঠেছে। শিশু হিসেবে এতে যুক্ত হতে পারলে এরপর সহযোগী ও শেষে ওস্তাদ হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করে তার পরিবার।’ গ্যারেজে ছোটদের কাজে রাখার কারণ চাইলে তিনি বলেন, ‘তাকে দিয়ে গাড়ির নিচের কাজগুলো করানো যায়। সারা দিনে কাজের যে হিসাব, ওস্তাদের ফুট ফরমায়েশ খাটার পরেও বেতন ছাড়া কাজ করানোর সুযোগ আর কোথাও হবে না। আর এটা যেহেতু অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে পড়ে এখানে শ্রম অধিদফতরের মনিটরিংয়ের দাবিও করা যাবে না।’
বেতন ছাড়া কাজের বিষয়ে শিশুবিষয়ক গবেষক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘‘গ্যারেজে কোন শিশুদের যেখানেই কাজে রাখা হয়, সেখানেই বেতন না দেওয়া এবং ‘কাজ শিখছে’ বলে দিনের বেশিরভাগ সময় খাটিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো দেখা যায়। বাবা-মা মনে করে, এখানে তার শিশুর ভবিষ্যৎ আছে। এখানে সে নিয়োগ পায় শিশু বলেই। যতক্ষণ খুশি খাটানো যাবে। শুরুর দুই বছর তাকে এই ‘কাজ শেখানো হচ্ছে’ বলে খাওয়ার টাকাও দেওয়া হয় না। তবে কম বয়সে কঠিন কাজে শিশুদের ঢোকালে সে কখনোই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। সে ওই হাতুরি নিয়েই কাজ করে যাবে, ওস্তাদ হয়ে বাইরে থেকে কাউকে এনে বসাবেন গ্যারেজ মালিক। এই শিশুদের শারীরিক যে প্রভাব, কখনোই সেটা আলাপে আসে না।’’ ১০/১২ ঘণ্টার কাজ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ওদের শ্রমিকের মর্যাদা নেই, ওদের কাজের মজুরির ঠিক নেই, ‘কাজ শেখাচ্ছি’ সেটার দোহাই দিয়ে সবই করানো হয়ে থাকে।’’