প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসের তুলনায় চলতি ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বেড়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। দেশে এখন কর্মহীন লোকের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার জন, যা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার। এই হিসাবে বেকার সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার।
বেকার কারা- আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, যাঁরা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং গত ৩০ দিন ধরে কাজ প্রত্যাশী ছিলেন, তাঁরা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এই নিয়মে বেকারের হিসাব দেয়।
গত ৬মে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) দেশে নতুন করে বেকার হয়েছেন ২ লাখ ৪০ হাজার জন। এই তিন মাসে নারী ও পুরুষ উভয় জনসংখ্যার মধ্যেই বেকারত্ব বেড়েছে। তবে গত বছরের একই প্রান্তিকের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, সার্বিক বেকারত্ব হার একই রয়েছে। কিন্তু পুরুষের বেকারত্ব বেড়েছে এবং নারীদের ক্ষেত্রে তা কমেছে।
দেশে কেন বাড়ছে বেকারের সংখ্যা এমন প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হয়। আর কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেলে বাড়ে বেকারত্ব।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়া, ডলার সংকটের মতো কারণ বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের পথে প্রধান বাধা। সহজে ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতার কারণেও নতুন বিনিয়োগ আসছে না বেসরকারি খাতে। যদিও বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগে যেসব কাজ করা হয়, তাতে খুব বেশি কর্মসংস্থান হয় না। এ অবস্থায় স্ব-কর্মসংস্থানে সুযোগ বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বেকারত্ব হ্রাসের উপায় নিয়ে যদি এখনই কোনও ধরনের বিকল্প পলিসি নেওয়া না হয়, শ্রমবাজারে যদি চাহিদা তৈরি না হয়, তাহলে কর্মসংস্থান বাড়ারও তেমন কোনও কারণ নাই। ফলে বেকারত্ব বাড়তেই থাকবে। বেকারত্ব সমস্যা সমাধান করতে হলে শিক্ষিত বেকারদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের সুদমুক্ত সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
চলতি বছরের ২ এপ্রিল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ম্যাক্রো পোভার্টি আউটলুক ফর বাংলাদেশ প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০২২-২৩ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি নতুন করে চরম দারিদ্র্য সীমায় পড়বে। অর্থাৎ, তাদের দৈনিক আয় হবে দুই ডলার ১৫ সেন্টের চেয়েও কম। আর মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছাবে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশে। এগুলোর সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতিও বেকারত্ব বাড়ার উদ্বেগজনক প্রবণতার চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর মতে, মৌসুমের কারণে বেকারের সংখ্যা ওঠানামা করে। এ কারণে গত বছরের শেষ প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বাড়াতে পারে। যেমন কৃষি খাতে একেক মৌসুমে শ্রমে নিয়োজিতদের হার বাড়ে বা কমে। ফলে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণে গত বছরের চতুর্থ কোয়ার্টারের সঙ্গে চলতি বছরের প্রথম কোয়ার্টারে বেকারত্বের হার বেড়েছে। তবে বেকারত্ব কমাতে হলে শ্রম বাজারে শ্রমের চাহিদা বাড়াতে হবে। চাহিদা না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ারও কোনও সম্ভাবনা নাই বলেও মনে করে সানেম।
এদিকে ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে সম্পাদিত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ বেকার।
বিআইডিএস’এর এই তথ্য সম্পর্কে বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাসরুর মনে করেন, প্রধানত তিন কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, দেশে বর্তমানে চাকরির সুযোগ বাড়ছে উৎপাদনশীল ও কৃষি খাতে; এই দুটি খাতে আবার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস তরুণদের কাজের সুযোগ কম এবং কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা বেশি। আবার যেসব শিক্ষিত যুবক চাকরির বাজারে রয়েছেন, তারা এসব কাজে নিজেদের যুক্ত করতে চান না। আর তৃতীয়ত, করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যেসব শিক্ষিত যুবক নিজেরা ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত ছিলেন, ওই সময়ে তারাও বেকার হয়ে পড়েছেন।
বাজারভিত্তিক শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, চাকরির বাজারে কারিগরি শিক্ষার চাহিদা রয়েছে। এই শিক্ষা গ্রহণে মানুষকে প্রভাবিত করতে হবে।
বিবিএস এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাদের ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। বাকিরা দেশের বাইরে যান। গত দুই দশক ধরে বেকারের সংখ্যা ২৪ থেকে ২৮ লাখের মধ্যে আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, নিজেদের উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে তরুণ ও শিক্ষিত যুবকেরা যাতে আগ্রহী হয় সেই সুযোগ তৈরি করতে হবে তাদের জন্য। আর নিজেদের উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রয়োজন হবে ব্যাংক ঋণের। সে জন্য তাদের সহজে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অর্থায়ন ব্যবস্থায় এ উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে আশানুরূপ বিনিয়োগের খুব বেশি সম্ভাবনা নেই। তাই ঋণসুবিধা বাড়িয়ে তরুণদের স্ব-কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াশিকা আয়শা খান জানিয়েছেন, দেশের অর্থনীতি ক্রমাগতভাবে ভালোর দিকে যাচ্ছে। কমছে মুল্যস্ফীতি। ডলারের দামও এখন স্থিতিশীল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় ভালো। এক কথায় বলা যায় দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ বিদ্যমান। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। আশা করছি এর সঙ্গে তাল দিয়ে বেকারত্বের হারও কমবে।