বাআ ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বের সব মুসলিম দেশ একসঙ্গে কাজ করলে, ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবসহ মুসলিমদের জন্য আরও ভালো অবস্থানে পৌঁছানো সহজ হতো। তিনি বলেন, “আজকে যদি আমাদের সকল মুসলিম দেশগুলো এক হয়ে একযোগে কাজ করতে পারতো, তাহলে আমরা এ বিষয়ে আরো অগ্রগামী হতে পারতাম।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার (৮ই মে) রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন আশকোনা হজক্যাম্পে ধর্ম মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘হজ কার্যক্রম ২০২৪’-এর উদ্বোধনকালে দেওয়া প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তিনি নিজেকে একমাত্র বোন (সরকার প্রধান) হিসেবে উল্লেখ করে- বলেন, “আমার এখানে একটাই কথা- সকলে এক হন এবং এ ধরনের অন্যায় অবিচার যেন আমাদের ওপর না হয়, সেজন্য সকলেই লক্ষ্য রাখবেন।”
আন্তর্জাতিক যে ফোরামে কথা বলেছেন সেখানেই ফিলিস্তিনীদের জন্য তাঁর কন্ঠ ‘সোচ্চার ছিল’- উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি প্রতিটি জায়গায় এর প্রতিবাদ করে যাচ্ছি। কারণ ফিলিস্তিনিরা আরব ভূখন্ডে তাদের জায়গা তারা পাবে, এটা তাদের অধিকার। এই অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। কাজেই সেই অধিকার তাদের দিতে হবে।
১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে জাতির পিতার ভাষণেরও এখানে উদ্ধৃতি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতির পিতা বলেন, “আরব ভাইদের উপর যে নিদারুণ অবিচার হয়েছে। অবশ্যই তার অবসান ঘটাতে হবে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরব ভূমি অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। জেরুজালেমের ওপর আমাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”
তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, কাজেই জেরুজালেমে মুসলমানদের যে অধিকার, এটা প্রতিষ্ঠা করার কথাও জাতির পিতাই তাঁর বক্তব্যে বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, আপনারা দেখছেন ফিলিস্তীনে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। সেখানে নারী ও ছোট ছোট শিশুদেরকেও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই তাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য ও সারাবিশ্বের মুসলিম উম্মাহর জন্য আপনারা (হজ যাত্রী) দোয়া করবেন।
তিনি হজযাত্রীদের কাছে দেশ ও জাতির জন্য দোয়া চেয়ে বলেন, তাঁর সরকার হাজিদের জন্য যে সুযোগ সুবিধা সংবলিত হজ ব্যবস্থাপনা করতে পেরেছে, সেটা ধরে রেখে যেন এটাকে আরো উন্নত করতে পারে- সে দোয়াটা আপনারা করবেন আর দেশের মানুষের জন্য দোয়া করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাদের মানুষের জন্য গোলা ভরা ধান দেন, পুকুর ভরা মাছ দেন, সুন্দর-উন্নত জীবন দেন, সেই দোয়া করবেন।” এ সময় তাঁর সরকার হজ ব্যবস্থাপনাকে আরো উন্নত করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ধর্ম মন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী ও বাংলাদেশে সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসুফ ঈসা আল দুহাইলান বক্তৃতা করেন।
হজ এজেন্সি এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার ও বক্তৃতা করেন। দু’জন হজযাত্রী অনুষ্ঠানে নিজস্ব অভিব্যক্তিও ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ২০২৪ সালের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি অডিও ভিজ্যুয়াল পরিবেশনা প্রদর্শিত হয় এবং শেষে দেশ-জাতি ও হজ যাত্রীদের সার্বিক মঙ্গল কামণায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
এ বছর মোট ৮৫ হাজার ২৫৭ বাংলাদেশী হজ পালন করতে পারবেন। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৫৬২ জন সরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং বাকী ৮০ হাজার ৬৯৫ জন ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করবেন। গত ৯ই মে বৃহস্পতিবার থেকে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের নিয়ে হজ ফ্লাইট সৌদির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথম হজ ফ্লাইট বিজি-৩৩০১ বিমানটি ৪১৯ জন যাত্রী নিয়ে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি এটুকু বলবো যে আজকে আমরা হজ ব্যবস্থপনাকে উন্নত করেছি, প্রতিবারই যারা যাচ্ছেন যে কোন সমস্যা হচ্ছে সেটাকে আরো উন্নত করার পদক্ষেপ নিচ্ছি। আর এক্ষেত্রে সৌদি সরকার সবসময় আমাদেরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তিনি সৌদি বাদশাহ এবং ক্রাউন প্রিন্সকে এজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
তাঁদের সার্বিক সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমান্বয়ে হজ ব্যবস্থাপনাটাকে আরো উন্নত করতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা করতে পেরেছি বলেই আপনারা আজকে সকলেই ভালোভাবে হজ করতে যেতে পারছেন, এটা আরো সহজ হয়েছে। এই হজ ক্যাম্পটার যথাযথ উন্নতি করে দিয়েছি। এখান থেকে একটি আন্ডারপাস করে দেওয়া হচ্ছে। যেটার মাধ্যমে হজক্যাম্প, বিমানবন্দর এবং রেলষ্টেশনের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হবে। এখানে যাত্রী ও মালপত্র পরিবহনে এস্কেলেটর ও গলফ কার্টের মত গাড়ি থাকবে। তাঁর সরকার সারাদেশে যে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করছে সেখানে হাজিদের প্রশিক্ষণ, রেজিষ্ট্রেশন সহ সেবা প্রদানকারিদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
সার্বিক বিমান পরিবহনের উন্নয়নে তাঁর সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সৌদি এয়ারলাইন্সে যেমন তেমনি নিজস্ব বিমানেও আমরা এখন হজযাত্রী আনা নেওয়া করতে পারি। আজকে আমরা ই-হজ ব্যবস্থাপনা করতে পেরেছি। কেননা ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা বাস্তবায়ন করেছি। আমাদের আগামী দিনের লক্ষ্য হচ্ছে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। এরপর আর কোন কষ্ট করতে হবেনা আপনারা ঘরে বসেই সব ব্যবস্থা পাবেন। সোজা প্লেনে উঠবেন, চলে যাবেন। সেই ধরনের ব্যবস্থা আমরা করতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে মালপত্র নেওয়া বা ওখান থেকে মালপত্র নিয়ে আসা বা জমজমের পানি নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। মক্কা-মদিনায় হজ অফিস স্থাপন করাসহ জেদ্দায় আলাদাভাবে টার্মিনালে জায়গা ভাড়া নিয়ে আমাদের হাজিরা যাতে সেখানে গিয়ে অবস্থান করতে পারেন সেই ব্যবস্থাটাও করেছি। আমরা যখন সরকারে এসেছি তখন থেকেই এই ব্যবস্থাটা নিয়েছি এবং প্রতিবছর টার্মিনালে এই ব্যবস্থাটা আমরা রাখি। কারণ আগে যাত্রীদের এখানে সেখানে ফুটপাতে বসে থাকতে হোত।
তিনি ১৯৮৪ সালে প্রথম ওমরাহ এবং ১৯৮৫ সালে হজ পালনে যাবার পর থেকেই দেখেছেন যাত্রীরা ফুটপাত বা এখানে সেখানে অবস্থান করছেন। তাদের অবস্থানের কোন জায়গা ছিলনা, তখন সরকারে না থাকলেও সৌদি প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে তিনি এসব অব্যবস্থাপনা দূর করার প্রচেষ্টা নেন যাঁর অনেকগুলোতেই সৌদি প্রশাসন সাড়া দেয়। তিনি বলেন, পরবর্তীতে সরকারে এসে আধুনিক হজ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলেছেন এটা ঠিক। কিন্তু পাশাপাশি এই হজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং ইসলামের সেবা করার জন্য ইসলামী ফাউন্ডেশন তিনি তৈরী করে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমার ব্যবস্থা এবং আয়োজনের জন্য জমি বরাদ্দ দিয়ে যান।
তিনি বলেন, ইসলাম সম্পর্কে মানুষের যেন সম্যক ধারণা হয় সেই ব্যবস্থাটা তাঁর হাতেই করা। স্বাধীনতার পর মাত্র ৩ বছর ৭ মাস সময় তিনি পান তার মধ্যেই এসব পদক্ষেপ নেন। রেডিও-টেলিভিশনে কোরআন তেলাওয়াত, ঈদে মিলাদুন্নবীতে ছুটি প্রদান- এসব কিছুই জাতির পিতা করে গেছেন। অর্থাৎ এদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিটাকে সম্মান জানিয়ে সকলে যাতে সহজভাবে ধর্মটা পালন করতে পারেন সে ব্যবস্থটা তিনি করে দিয়ে যান।
এ সময় আজকে দেশের যে উন্নয়ন সেটা দেশবাসী সকলের সহযোগিতাই সম্ভব হয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। এদেশে যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে, শান্তির ধর্ম ইসলাম এবং আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) আমাদের সে শিক্ষাই দিয়ে গেছেন উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, কাজেই আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এ ধরনের কাজ যেন কেউ না করেন।
মদ, জুয়া, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ করে মুষ্টিমেয় লোক আমাদের পবিত্র ধর্মের নামে যে বদনাম দিয়ে যায় সেটাই দু:খজনক। শেখ হাসিনা বলেন, আমি এটারও প্রতিবাদ করি সবসময়। কারণ আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করতে চাই। মানুষের উন্নয়ন করতে চাই।