প্রশান্তি ডেক্স ॥ বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন আবারও ঘূর্ণিঝড়ের প্রচন্ড আঘাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তান্ডব এই বনাঞ্চলে যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তা এর আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর তুলনায় ভয়াবহ। এরইমধ্যে জানা গেছে কী পরিমাণ প্রাণ-প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাঁধ ভেঙ্গে নোনাজলে ডুবেছে বিস্তীর্ণ এলাকা।

এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ত্রাণের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কী চায় সুন্দরবন ও তার আশপাশের মানুষ। প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন যারা, তারা বলছেন এখন ভাতের টান নেই। ঘরও হয়তো উঠে যাবে। কিন্তু যে নোনাজল ঢুকে গেছে, সেটা দ্রুততম সময়ে সেচ করে ফেলে দিয়ে বৃষ্টির অপেক্ষা করতে হবে। যেন সেই জল নতুন করে জমা হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর বাঁধ দিয়ে আরও নোনাজল ঢোকা থামাতে হবে। প্রাণ বাঁচলে তবে না ভাত খাওয়া যাবে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার (৩০ মে) খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো সাংবাদিকদের জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তান্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি। বনের বিভিন্ন স্থান থেকে আরও ৫৭টি হরিণ এবং চারটি শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে ৩৯টি হরিণ এবং একটি শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। এ নিয়ে মোট ১০১টি বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হলো। এ ছাড়া জীবিত ১৮টি হরিণ ও একটি অজগর উদ্ধার করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের পর জলোচ্ছ্বাসে খুলনার আট হাজার ৮৭৫ পুকুর ও মৎস্যঘের ভেসে গেছে। সুন্দরবনকে ঘিরে যাদের জীবন-জীবিকা, সেই মানুষদের জন্য বাঁধ পুননির্মাণ এখন প্রধান কাজ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় চলে যাওয়ার পরে এরইমধ্যে সুন্দরবনের আশপাশের নদী জোয়ারের পানিতে ভরতে শুরু করেছে। নদীর তীরের ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ আটকাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন শত শত মানুষ। খুলনার দাকোপ উপজেলার বটবুনিয়া বাজারসংলগ্ন এলাকার বাঁধ দফায় দফায় ভেঙ্গেছে। সেখানে খাওয়ার পানি নেই। বাঘে-মানুষে একঘাটে পানি খেতে গেলে প্রাণনাশের শঙ্কা আরও বাড়বে।
এই মুহূর্তে সবার আগে সুপেয় পানি দরকার। পুকুরগুলো লবণমুক্ত না করলে লোকালয় ও বন কোনোটাই রক্ষা হবে না উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘জ্যৈষ্ঠ মাসে সাগরে লবণাক্ততা থাকে সবচেয়ে বেশি। লোকালয়ে ঢুকে যাওয়া লবণ পানি আপনা-আপনি বেরোনোর পথ রুদ্ধ। এই পানি বের করাটাই মূল কাজ। এখন ব্যক্তি পর্যায়ে না ভেবে কমিউনিটি নিয়ে ভাবতে হবে। দ্রুত সব পুকুরের পানি সেচে ফেলতে হবে। বৃষ্টির পানি সেখানে জমা হলে প্রাণ বাঁচবে। আর দ্বিতীয় কাজ হলো বাঁধ দিয়ে নোনাপানি ঢোকা ঠেকানো। সব ধরনের স্বেচ্ছাসেবী, সব বাহিনীকে এই কাজে নিয়োজিত করতে হবে। ত্রাণ হিসেবে ভাত, বাড়ির ছাউনি নিয়ে না ভেবে, এখন এই দুটো কাজ সবার আগে করতে হবে।’
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রিমালের আঘাতে সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগের ফরেস্ট স্টেশন অফিস, ক্যাম্প ও ওয়াচ টাওয়ারের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনের ভেতরে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যোগাযোগমাধ্যম ওয়্যারলেস টাওয়ারও। মিষ্টি পানির পুকুর তলিয়েছে লবণাক্ত পানিতে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের পর জলোচ্ছ্বাসে খুলনার ১২ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। সুন্দরবনে জলোচ্ছ্বাসে পানি প্রবেশ নতুন কোনও ঘটনা নয় উল্লেখ করে ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’র (ধরা) সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে তা মারাত্মক রূপ নেবে বিজ্ঞানীরা এ কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। উজানের পানিপ্রবাহ কমে সুন্দরবনে লবণাক্ততাও বেশ আগেই অনেক বেড়ে গেছে। কাজেই বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার অনেক আগে থেকেই সুন্দরবনের ভেতর পরিকল্পিত পুকুর এবং মিঠাপানির পরিখা খননের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু যথাযথ সক্ষমতা, সুশাসন ও পর্যবেক্ষণ না থাকায় বাংলাদেশ অংশে এসব ব্যবস্থা এখনও তেমন সুফল বয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। রিমালের পরবর্তী সময়ে সেটির ভয়াবহতা আরও বেড়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে মিঠাপানির সুব্যবস্থা করাটা প্রধান চ্যালেঞ্জ।’