প্রশান্তি ডেক্স ॥ তামাক ব্যবহারের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এছাড়াও সরাসরি তামাক গ্রহণ ও ধূমপানে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ব্যাধিসহ মুখ, গলা, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয়, কিডনি, লিভার এবং পাকস্থলীর মতো একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে এবং ২০টিরও বেশি ধরনের ক্যানসার রোগ ঘটায়। ২০২৩ সালে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশেও এর প্রভাব কম নয়। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী গত শুক্রবার (৩১ মে) পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’।
এ বছর ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’-এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্রোটেক্টিং চিলড্রেন ফ্রম টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ইন্টারফেয়ারেন্স’; যার বাংলা অর্থ করা হয়েছে, ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’।
প্রতি বছর ৩১ মে বিশ্বজুড়ে এই দিনটি পালন করা হয়। বিশ্বজুড়ে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সব প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকাকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটি প্রচলিত হয়েছে। এছাড়াও দিবসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, তামাকের ব্যবহার বর্তমানে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিবেচিত এবং ধূমপানের পরোক্ষ ধোঁয়ার প্রভাবের কারণে প্রায় ৬ লাখ অধূমপায়ীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সদস্য রাষ্ট্রগুলো ১৯৮৭ সালে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’ চালু করে। বাংলাদেশেও দিবসটি পালন উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দিবসটি উপলক্ষে সরকারিভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সকাল সাড়ে ৭টায় র্যালি করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ও প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর থেকে শুরু হয়ে র্যালিটি ইস্কাটন রোডে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব কনভেনশন হল প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। র্যালি শেষে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে সেমিনার এবং একই দিন বিকালে সেখানে ‘স্বাস্থ্য মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়।
২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ অর্জনের লক্ষ্য পূরণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এবং কার্যকর, তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)। সংগঠনটি বলছে, তামাকই পৃথিবীর একমাত্র বৈধ পণ্য, যা অবধারিতভাবে তার ভোক্তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এক প্রজন্মের তামাকসেবী যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, কিংবা ঘাতক ব্যাধির প্রকোপে তামাক সেবন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই তামাক কোম্পানির জন্য তখন নতুন প্রজন্মের তামাকসেবী তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যে কিশোর-কিশোরী আজ ঠোঁটে তামাকপণ্য তুলে নিচ্ছে, কাল সে-ই পরিণত হচ্ছে তামাক কোম্পানির আমৃত্যু খদ্দেরে। কেবল বাংলাদেশেই তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যুতে তামাক কোম্পানিগুলোকে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার ভোক্তা হারাতে হয়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাই সর্বদা চলে নতুন ভোক্তা তৈরির কাজ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিনের অত্যন্ত আসক্তি এবং তামাকের ব্যবহার কার্ডিওভাসকুলার ও শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ অন্যান্য রোগ দুর্বল স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর প্রধান ঝুঁকির কারণ। তামাক অধূমপায়ীদের জন্যও মারাত্মক হতে পারে। সেকেন্ড-হ্যান্ড বা পরোক্ষ ধূমপান স্বাস্থ্যের প্রতিকূল ফলাফলের সঙ্গে জড়িত। যার ফলে বছরে ১২ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। প্রায় অর্ধেক শিশু তামাকের ধোঁয়া দ্বারা দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয় এবং ধূমপানের কারণে মায়ের গর্ভাবস্থায় প্রতিবছর ৬৫ হাজার শিশু মারা যায়। গর্ভাবস্থায় ধূমপান শিশুর জীবনব্যাপী স্বাস্থ্যগত অসুস্থতার কারণ হতে পারে।
তামাক সম্পর্কিত অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার কমাতে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ জরুরি বলেও মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তামাক কোম্পানিগুলোর কূটচাল সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে অবহিত করা এবং এসব অপতৎপরতা মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সংস্থাটির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে ১৩-১৫ বছর বয়সী অন্তত ৩ কোটি ৭০ লাখ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত তামাক ব্যবহার করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের (সিডিসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ বছর বয়সের আগেই যারা তামাকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন, তাদের মধ্যে নিকোটিন নির্ভরতা এবং আমৃত্যু তামাক ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। কিশোর-কিশোরী, বিশেষ করে ১৩-১৯ বছর বয়সীদের দিকে তামাক কোম্পানিগুলোর দৃষ্টির কথা এখন আর অজানা নয়।
আমেরিকান বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের ১৯৮১ সালের একটি অভ্যন্তরীণ গোপনীয় সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আজ যে কিশোর-কিশোরী (টিনএজার), আগামী দিন সে-ই হবে আমাদের নিয়মিত ভোক্তা।’ অল্প বয়সীদের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডে আসক্ত করতে কোম্পানিগুলো নানা ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়।
প্রজ্ঞা জানিয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ। টোব্যাকো অ্যাটলাস-এর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬ শতাংশ।
অপরদিকে, ২০১৪ সালে পরিচালিত গ্লোবাল স্কুল-বেজড হেলথ সার্ভে (জিএসএইচএস) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাকপণ্যের প্রচার ও বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে তামাক কোম্পানির লোভের মুখে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের তরুণ সমাজ।
২০১৬ সালে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত মোট ১১০টি স্কুলের পারিপার্শ্বিক এলাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, স্কুলগুলোর ১০০-মিটার ব্যাসার্ধ এলাকার ভেতরে মোট ৬৬১টি মুদি দোকান এবং চায়ের দোকান রয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৯১টিতেই তামাকপণ্য বিক্রয় হয়। ১১০টি স্কুলের মধ্যে কেবল ৫টির ক্ষেত্রে নিকটবর্তী খুচরা বিক্রেতাদের তামাকপণ্য প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে দেখা গেছে। স্কুলগুলোর ১০০ মিটার ব্যাসার্ধ এলাকার মধ্যে অবস্থিত মোট ৫০৭টি মুদি দোকানের ৪৮৭টিতেই চকলেট, ক্যান্ডি, কোমল পানীয় ইত্যাদির পাশেই তামাকপণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমান মোট জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশই তরুণ-তরুণী। তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট হচ্ছে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তামাকে আসক্ত করে ব্যবসা বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উচিত তামাক কোম্পানির ছোবল থেকে এদের সুরক্ষা প্রদান করা। এর জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনীর কাজ দ্রুত চূড়ান্ত হবে।
তার মতে, ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্ত, ই-সিগারেটসহ সব ধরনের ভ্যাপিং-পণ্য নিষিদ্ধ এবং তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধসহ আইনের অন্যান্য ধারার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের অর্থ ব্যবহার করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি বা কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তামাক কোম্পানির কূটকৌশল ও হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) আর্টিকেল ৫.৩ অনুসারে, নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তামাকপণ্যের দাম কার্যকরভাবে বাড়িয়ে অল্প বয়সী জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে। তামাকের ব্যবহার কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তামাক সেবনকারীর সংখ্যা ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে সরকার কাজ করছে। সংশোধিত আকারে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি খুব শিগগিরই সংসদে পাস করা হবে।