বাআ ॥ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ পরিহার, বৈদেশিক মুদ্রার অযথা ব্যয় না করা, অতিদারিদ্রের হার শূন্যে নামিয়ে আনা, প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে অতিক্রম করে সংবেদনশীল ও জনমুখী প্রশাসন গড়ে তোলাসহ জনমুখী প্রশাসন গড়তে ৩৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমান সরকারের প্রথম সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের জোর তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
গত ৭ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠি ইতোমধ্যে সব মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধিদপ্তর প্রধানদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়/বিভাগের কার্যক্রম চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়মিত পরিবীক্ষণ করতে হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের চারটি স্তম্ভ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজ গঠন নিশ্চিত করতে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের করণীয় চিহ্নিত করে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
জাতীয় সংসদের কার্যক্রম যথাযথভাবে সহায়তা করতে হবে। আইন-প্রণয়ন পদ্ধতি ও সংসদের কার্যপ্রণালী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর যথাযথভাবে সহায়তা করতে হবে। প্রশ্নোত্তর পূর্বে সংসদের মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি হ্রাসে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। মূল্যস্ফীতির হার যেন প্রবৃদ্ধির হারের নিচে থাকে সে লক্ষ্যে সমম্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি ও বাজার ব্যবস্থা নিয়মিত পরিবীক্ষণ করতে হবে। সমন্বিতভাবে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। পণ্য পরিবহনের পথে চাঁদাবাজি বন্ধের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধিকল্পে করজাল (ট্যাক্স নেট) সম্প্রসারণ করতে হবে। কেউ যেন কর ফাঁকি দিতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিভিন্ন স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোকে অটোমেশন করতে হবে। কর-ভ্যাট-শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সব ধরনের অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।
বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যেন সহযোগিতার অভাবে ফেরত না যায় তাও নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করা ও কোনো প্রতিকূলতা থাকলে তা দ্রুত দূর করতে হবে। সরকারি ব্যয়ে মিতব্যয়ী হতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা যেন অযথা ব্যয় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
যে-সব প্রকল্প অল্প ব্যয় করলেই শেষ হয়ে যাবে সেগুলো দ্রুত বরাদ্দ দিয়ে বাস্তবায়ন কাজ শেষ করতে হবে। উন্নয়ন অর্থ কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয়। সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়াই হলো প্রকৃত উন্নয়ন। প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কতটা উপকারে আসবে বা কী সুফল পাওয়া যাবে তা বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া প্রকল্প থেকে কখন সুফল আসবে তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ পরিহার করতে হবে। অহেতুক ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না।
যে-সব অবকাঠামো তৈরি হয়েছে বা যে-সব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে সেগুলো যেন টেকসই হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অতিদারিদ্রের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাদের ঘর দেওয়া হয়েছে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
রপ্তানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে আসবাবপত্র, পাটজাত দ্রব্য, চামড়া, হস্ত/কারুশিল্পকে গার্মেন্টসের মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব-ইউরোপ, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল বা দেশে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
জুট জেনোম আবিষ্কার হওয়ায় পাটের বহুমুখী ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাটের বহুমুখী ব্যবহার এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনতে হবে। বিশেষভাবে চরাঞ্চলে বাদাম, শষ্যসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে ভোজ্যতেলের আমদানি কমাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে তিলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তিল চাষ বাড়াতে পারলে রপ্তানির সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।
কোনো অবস্থাতেই তিন ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না। সেদিকে কর্মকর্তাদের নজর রাখতে হবে। খাদ্য, সবজি ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে সহায়তা করতে হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে। সেচযন্ত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শিল্পকারখানায় সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হবে।
কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে সার্ভিস সেক্টরে সার্টিফিকেট কোর্সসহ মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যুগের পরিবর্তন ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বইমেলাকে ক্রমান্বয়ে উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিশোর গ্যাং ও ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশু-কিশোররা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে কিনা তা পরিবীক্ষণ করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে সাময়িক (সামরিক) শাসনের জারি করা অধ্যাদেশগুলোর মধ্যে যে ১৬টি আইন এখনও বিযুক্তিকরণ সম্পন্ন হয়নি সেগুলো দ্রুত বিযুক্তিকরণ করতে হবে।
শূন্যপদে নিয়োগের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া নিয়মিত পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। পদোন্নতির সময় নারী কর্মকর্তারা যেন অন্যায়ভাবে বঞ্চিত না হন সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে।
জলাধার সংরক্ষণ ও সংস্কার করতে হবে। উন্নয়ন কর্মকান্ডে বা অন্য কোনো কারণে নদীর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। সেচের কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির বদলে ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার বাড়াতে হবে।
সুনীল অর্থনীতির আওতায় সমন্বিতভাবে সমুদ্রের সম্পদ আহরণের ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যটন বিকাশে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। দুর্নীতি দমন শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের একার কাজ নয়। এ বিষয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সরকারি সব সেবা অনলাইনভিত্তিক করতে হবে। প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে অতিক্রম করে সংবেদনশীল ও জনমুখী প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।
সচিবদের আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে হবে। সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তসমূহের বিষয়ে সচিবদের ব্যক্তিগত মনোযোগ আকর্ষণ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আপনার মন্ত্রণালয়/বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে অবহিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রথম সচিব সভা অনুষ্ঠিত হয়। সচিব সভা বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের চিঠি পাওয়ার পর তারা কার্যক্রম শুরু করেছেন জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ও দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন তারা।