বাআ ॥ জানুয়ারি ১৯৬৬: তাশখন্দে পাকিস্থানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের জন্য নিজেদের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারা যান।
ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ : পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে পাকিস্থানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের একটি সম্মেলনে ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরের দিন একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মে ১৯৬৬ : শেখ মুজিবুর রহমান-সহ অসংখ্য প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে পাকিস্থানের প্রতিরক্ষা নীতি দেখিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময়ে, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আইয়ূব খান ছয় দফার সমর্থকদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের হুমকি প্রদান করেন।
নভেম্বর ১৯৬৭ : আইয়ুব খানের একান্ত অনুগত এবং সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্থান পিপলস পার্টি গঠন করেন।
ডিসেম্বর ১৯৬৭ : মাসের শেষের দিকে, পাকিস্থান সরকার বেশ কয়েকজন বাঙ্গালীকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শাসকগোষ্ঠীর পরবর্তী কার্যকলাপের প্রথম লক্ষণ ছিলো এটি।
জানুয়ারি ১৯৬৮ : মাসের শুরুতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্থান সরকার ১৯৬৬ সাল থেকে আটক থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়িত করে। বেসামরিক কর্মকর্তা ও সামরিক অফিসারসহ মোট ৩৫ জন বাঙ্গালিকে জোরপূর্বক অভিযোগ আনা হয় যে তারা পূর্ব পাকিস্থানকে পাকিস্থানের বাকী অংশ থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
জুন ১৯৬৮ : ঢাকার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের বিচার শুরু হয়। বিচারপতি এস.এ. রহমানের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনালে দু’জন বাঙ্গালি বিচারক ছিল, যথা: বিচারপতি মুজিবুর রহমান খান এবং বিচারপতি মাকসুমুল হাকিম। বিচারের প্রথম দিনেই শেখ মুজিবুর রহমান একজন বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, “আপনি জানেন, তারা আমাকে ছয় মাসের বেশি এখানে রাখতে পারবেন না।”
অক্টোবর ১৯৬৮ : যখন আইয়ুব সরকার তাদের ক্ষমতার দশ বছর উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন পাকিস্থানজুড়ে ব্যাপক রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
নভেম্বর ১৯৬৮ : পেশোয়ারে আইয়ুব খানকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। সে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যায়। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই, পাকিস্থান সরকার ভুট্টো ও খান আবদুল ওয়ালি খানকে প্রতিরক্ষা আইন অনুসারে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের কয়েকদিনের মধ্যে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ ও এয়ার মার্শাল আসগর খান সরকার বিরোধী হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
জানুয়ারি ১৯৬৯ : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে পূর্ব পাকিস্থানে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্থানেও এই সরকার বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ : ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা সেনানিবাসে প্রহরীরা গুলি করে হত্যা করে। ২২ তারিখে আগরতলা মামলাটি নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান-সহ সকল আসামিকে মুক্তি দেয়া হয়। তার পরদিনই ঢাকার রেসকোর্সে এক বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এবং মার্চের শুরুতে রাওয়ালপিন্ডিতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।
মার্চ ১৯৬৯ : রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পুরো পাকিস্থানজুড়ে সামরিক আইন ঘোষনা করা হয়। ইয়াহিয়া দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির বিষয়ে জোর দেন।
জানুয়ারি ১৯৭০ : আইনি আদেশের অধীনে পাকিস্থানে রাজনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় চালু হয়। তখন থেকেই দেশে সাধারণ নির্বাচনের মাঠ প্রস্তুত হতে থাকে।
নভেম্বর ১৯৭০ : একটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় পূর্ব পাকিস্থানের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। এতে দশ লাখ বাঙ্গালীর প্রাণহানী ঘটে।
ডিসেম্বর ১৯৭০ : ডিসেম্বরের সাত তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্থানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ভুট্টোর পাকিস্থান পিপলস পার্টি ৮৮ টি আসন জয়লাভ করে, যেগুলোর সবই ছিলো পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে।
জানুয়ারি ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধু-সহ আওয়ামী লীগের বাকি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মিলে ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্থানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ণের প্রতিশ্রুতি দেন। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনার জন্য জানুয়ারির শেষের দিকে ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্থান পিপলস পার্টির একটি দল ঢাকায় আসে। আওয়ামী লীগ এই জোট সরকারের পক্ষে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।
ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ : রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান মার্চের ৩ তারিখ ঢাকায় জাতীয় সংসদ অধিবেশন আহ্বান করেন। এর কয়েকদিনের মাথায় ভুট্টো ঘোষণা দেয়, ছয় দফার বিষয়ে আওয়ামী লীগ তার অবস্থান পরিবর্তন না করলে তিনি এ অধিবেশন বর্জন করবেন। আওয়ামী লীগ তার পক্ষ থেকে পাকিস্থান পিপলস পার্টির রিজার্ভেশন বাতিল করে দেয়।
মার্চ ১৯৭১ : মাসের প্রথম দিনই বিস্ময়কর এক বিবৃতিতে জেনারেল ইয়াহিয়া খান মাত্র দুইদিন পরই অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেয়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্থানে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এর পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মার্চের ৭ তারিখ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে লাখো বাঙ্গালীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ১৬ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিষয়ে আলোচনা চলে। পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্থানে গণহত্যা চালায় পাকিস্থানী সেনাবাহিনী। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এর কিছুক্ষণ পরই, তিনি পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর হাতে আটক হন।