প্রশান্তি ডেক্স ॥ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকান্ডের ঘটনায় একের পর এক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উঠে আসছে। সোনা চোরাচালানের বাইরেও স্থানীয় রাজনৈতিক শত্রুতাও এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে কাজ করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহের স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথাগত তদন্ত ও ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে খুনিদের সঙ্গে অনেকের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সন্দেহভাজনদের নজরদারি ও গ্রেফতার করা হচ্ছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আজীম হত্যাকান্ডের ঘটনায় অন্যতম প্রধান খুনি শিমুল ভুঁইয়ার সঙ্গে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। তার বিরুদ্ধে আনার হত্যাকান্ডের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। হত্যাকান্ডের পর জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বাবু ঢাকায় গিয়ে শিমুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আজীমকে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর বাবু সেই খবর মিন্টুকে জানিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে বাবু স্বীকার করেছেন, মূল খুনি শিমুল ভুঁইয়ার সঙ্গে তিনি একাধিকবার মিটিং করেছেন। তার সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথাও হয়েছে। একপর্যায়ে বাবু মৃত এমপি আনারের ছবিও মিন্টুকে পাঠান।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) সাইদুল ইসলাম মিন্টুকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তবে রিমান্ড শুনানির সময় মিন্টু আদালতকে খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, দ্বাদশ নির্বাচনে এমপি পদে মনোনয়ন চাওয়াই ছিল তার অপরাধ। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বলেও আদালতকে জানান।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘তদন্তে কারও সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনও সংশ্লিষ্টতা না পেলে আমরা কাউকে ডাকি না। শিমুল ভূঁইয়ার ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি এবং মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাবুর জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শিমুল ভূঁইয়াকে আবার রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
মহানগর ডিবি প্রধান আরও বলেন, ‘আনারকে হত্যার পর লাশ গুম করে গত ১৫ মে খুনি শিমুল দেশে এলেন। পরে শিমুল ঢাকা এলে তার সঙ্গে মিন্টুর প্রতিনিধি যোগাযোগ কেন করলেন? ১৬ মে থেকে মিন্টু জানেন এমপি আনার খুন হয়েছেন অথচ আমরা জানি ২২ মে। এমপি আনারকে হত্যার পর তোলা ছবি যদি মিন্টু ১৬ মে দেখে থাকেন, তাহলে তিনি কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেননি? মিন্টু হত্যার বিষয়ে জেনেও কেন জানালেন না এবং টাকাপয়সা লেনদেনের বিষয়টিও গ্রেফতার ব্যক্তিদের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এসেছে। সবকিছুই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করবো।’
সূত্র আরও জানায়, এমপি আজীম হত্যাকান্ডের এক সপ্তাহ আগে ৬ মে শিমুল ভুঁইয়া মিন্টুর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেন। সে সময় দুই কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়ে আলোচনা হয়। এই টাকা ২৩ মে ঢাকায় পরিশোধ করার কথা ছিল। এ জন্য মিন্টুর অন্যতম সহযোগী বাবু ওরফে গ্যাস বাবু ঢাকায় এসে শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। হত্যাকান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত হতে শিমুলের কাছ থেকে আনারের মরদেহের ছবি নেয়। গ্যাস বাবুর মাধ্যমে সেসব ছবি দেখে মিন্টু মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হন।
পুলিশ যাতে বাবু ও মিন্টুকে সন্দেহ করতে না পারে, এ জন্য আলোচিত এই হত্যাকান্ডের অন্যতম মূল হোতা আক্তারুজ্জামান শাহীন বাবুর ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল ফোন নিজের হেফাজতে নেন। পুলিশের ধারণা, ফোনগুলো আক্তারুজ্জামান শাহীন অজ্ঞাত কোনও স্থানে ফেলে দিয়েছেন অথবা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছেন।
গত ১২ মে ভারতে যাওয়ার পর নিখোঁজ হন এমপি আনোয়ারুল আজীম ওরফে আনার। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। তার শরীরের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় সঞ্জিভা গার্ডেনের ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংকে। আর হাড় ফেলা হয় খালে।
নির্মম এই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে এই হত্যাকান্ডে জড়িত হিসেবে এ পর্যন্ত ১২ জনের নাম এসেছে। এর মধ্যে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর, সেলেস্তি রহমান, বাবু ও মিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বাবু ও মিন্টু ছাড়া বাকিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ ছাড়া ভারতে গ্রেফতার করা হয়েছে সিয়াম ও কসাই জাহিদকে। হত্যাকান্ডের অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন ঘটনার পর ভারত ও নেপাল হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। অন্যদিকে হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া দুই সন্দেহভাজন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল এখনও পলাতক রয়েছে।