প্রশান্তি ডেক্স ॥ সরকারঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ও প্রভাবশালী সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছিল দুর্নীতিবাজরা। এরই মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের খবর প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গণমাধ্যমে। সবশেষ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের হাজার কোটি টাকার সম্পদের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর রীতিমতো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা। প্রশাসন ও পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ে চলছে আলোচনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলধারার অনেক গণমাধ্যমকে ‘ম্যানেজ’ করতে পারলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুর্নীতি করে গড়ে তোলা সম্পদের তালিকা ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় অনেকেই দেশে গড়ে তোলা সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা বিদেশে পাচারের সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সরাসরি বা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপগুলোতেও চলছে এই আলোচনা। সবারই একই প্রশ্ন এর পরে কে? কার বিপুল সম্পত্তির খবর প্রকাশিত হবে গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে? অনেক কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের কাছে খোঁজ-খবর নেওয়ারও চেষ্টা করছেন।
প্রশাসন ও পুলিশের সাবেক-বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ায় সাধুবাদ জানাচ্ছেন অনেক সৎ কর্মকর্তা। তারা মনে করছেন, টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে অনেক কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় পদে দায়িত্ব পালন করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাদের ধারণা ছিল, বর্তমানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সরকারে থাকা অবস্থায় কখনোই তাদের বিপাকে পড়তে হবে না। কিন্তু বেনজীর, আছাদুজ্জামান মিয়া বা এনবিআর কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের খবর প্রকাশের পর অন্যান্য দুর্নীতিবাজরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, সৎভাবে চাকরি করার কারণে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছরেও ভালো কোনও জায়গায় পোস্টিং পাননি। কারণ ভালো জায়গায় পোস্টিং পেতে হলে ঊর্ধ্বতনদের বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়। এত টাকা তার নাই এবং টাকা দিয়ে পোস্টিং পাওয়ার ইচ্ছেও তার ছিল না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকের তুলনায় বর্তমানে দেশের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের নিয়ে সাধারণ মানুষ কথা বলছে। গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে বিষয়গুলো ভাইরাল হচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও দুর্নীতিবাজদের পক্ষ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলছেন, মানুষের মধ্যে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, এটা অবশ্যই আশার কথা। যদিও আপাতত এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যদি স্থায়ী রূপ লাভ করে এবং পক্ষপাতহীন হয় তাহলে এটা কাজ করবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হলেই দুর্নীতি কমিয়ে আনা যাবে।
সাবেক এই আমলা বলেন, প্রশাসন বা পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগগুলোর কেবল অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে মামলা হবে। মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে। বিচারে রাষ্ট্রপক্ষকে দুর্নীতির বিষয়গুলো প্রমাণ করতে হবে। তারপর রায়ে যদি শাস্তি হয়, যদি যথাযথ বিচার হয়, তবেই ভালো প্রভাব পড়বে।
আতঙ্কে দুর্নীতিবাজরা, স্থাবর সম্পদ বিক্রির চেষ্টা : সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই নিজের নামে সম্পদ না কিনে স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের নামে কেনেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অসংখ্য দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরাও দুদকের মামলার আসামি হয়েছেন। এ কারণে বর্তমানে অনেক দুর্নীতিবাজ স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের নামে স্থাবর সম্পত্তি না কিনে বিদেশে পাচার করছেন। ছেলে-মেয়েদের কাউকে বিদেশে পড়াশোনা করতে পাঠানোর নামে সেখানেই দুর্নীতির অর্থ পাঠাচ্ছেন।
গংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি জনপ্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক সরব হওয়ার কারণে অনেকেই স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করছেন। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে যারা ভূ-সম্পত্তি বা ফ্ল্যাট কিনেছেন তারা সেসব ভূ-সম্পত্তি বা ফ্ল্যাট বিক্রির চেষ্টা করছেন। এছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে আত্মীয়-স্বজনদের নামে বিনিয়োগের চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই এবং ইউরোপের পর্তুগাল ও রোমানিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এসব দেশে বিনিয়োগ করলে সহজেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় তার বসের একটি ফ্ল্যাট ছিল। অনেক অর্থ ব্যয় করে তিনি ফ্ল্যাটটি সাজিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে তিনি তড়িঘড়ি করে শখের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিয়েছেন।
অভিযোগ উঠলেই সক্রিয় হওয়া উচিত দুদকের : পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত শুরু করলেও সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু হয়নি। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেছেন, আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের তথ্য প্রকাশের খবর তার নজরে আসেনি। কারও সম্পদ থাকলেই সেটা অবৈধ হবে, তা নয়। যদি সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তার জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে দুদক ব্যবস্থা নেবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক মহাসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, যে কোনও সূত্র থেকে দুর্নীতির খবর পেলেই দুদকের অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দুদকের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে অভিযোগ আসা বা কেউ অভিযোগ দেবেন, সেজন্য অপেক্ষা করা উচিত না। পত্রপত্রিকা বা সোশ্যাল মিডিয়াতে খবর আসাটাও একটি সূত্র। যে কোনও সূত্রে দুর্নীতির খবর এলেই দুদকের কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
‘ব্যক্তির দায় ব্যক্তিকেই নিতে হবে’ : পুলিশের সাবেক দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদের খবর প্রকাশের পর পুলিশ নিয়ে নেতিবাচক ও অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে বলে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএসএ)। পুলিশ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিপিএসএ’র পক্ষ থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘কিছু মিডিয়া হাউজ ব্যক্তিগত আক্রোশ ও নিজস্ব স্বাথ্যরক্ষায় কোনও কোনও পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবমাননাকর নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করছেন, যা সাংবাদিকতার নীতিমালা বিরোধী। কী কারণে, কার উদ্দেশ্য হাসিল এবং কার ম্যানডেট বাস্তবায়নের জন্য কতিপয় মিডিয়া বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরণের কুৎসা রটনায় লিপ্ত- সেই প্রশ্ন উত্থাপন করা অযৌক্তিক নয়।’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কোনও এক রহস্যময় কারণে এক শ্রেণির গণমাধ্যম অতিসুকৌশলে পুলিশকে বিতর্কিত করে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় মেতেছে। এ ধরণের সাংবাদিকতা পুলিশের সৎ, নিষ্ঠাবান, পেশাদার ও দেশপ্রেমিক সদস্যদের মনোবল ধ্বংসের অপপ্রয়াস বলে প্রতীয়মান হয়, যা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘কোনও পেশার লোকজনই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করে না। যে কারও বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ আসতে পারে। পুলিশ অবশ্যই প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে অনুসন্ধান হবে, অনুসন্ধানের পর তদন্ত হবে। তবে একথা সত্য নির্বিচারে বা ঢালাওভাবে এসব বলা যাবে না। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণসহ বলতে হবে।’
একজন মন্ত্রী যদি কোনও একটি অপরাধমূলক কাজ করেন, তবে কি তার দায় গোটা সরকারের ওপর বর্তাবে? এই প্রশ্ন রেখে সাবেক এই আমলা বলেন, ‘ব্যক্তির দায় কখনোই বাহিনীর ওপরে আসবে না। ব্যক্তির দায় ব্যক্তিকেই নিতে হবে।’