প্রশান্তি ডেক্স ॥  ‘নদী ভাঙ্গছে। বাড়ি নাই, ঘর নাই। হামার একটেও জায়গা নাই। মাইনষের বাড়িত যাবার নাগছি। ছাগল-গরু সউগ মাইনষের বাড়িত থোয়া নাগবে।’ বলেই মুখে কাপড় গুঁজে কান্না শুরু করেন বিভা রানী। মুখ লুকিয়ে ডুকরে কাঁদতে থাকেন। তিস্তার ভাঙ্গনে বিভা রানী বসতভিটা হারিয়েছেন। নতুন করে বসতি গড়ার জায়গা নেই।

বিভা রানী কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চতুরা কালিরহাট গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর নিবারণের স্ত্রী। আগ্রাসী তিস্তার ভাঙ্গনে তার বসতভিটার অর্ধেকেরও বেশি বিলীন হয়েছে। শেষ রক্ষা হবে না জেনে ঘর ও অন্যান্য উপকরণ সরিয়ে নিচ্ছিলেন। গত শুক্রবার (২১ জুন) দুপুরে এমন পরিস্থিতিতে কথা হয় তার সঙ্গে।

বিভা জানান, পরম যত্নে সাজানো সংসার তিস্তার ভাঙ্গনে মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে গেছে। তারা অসহায়, নিরুপায়। বেদনার সেই কথা বলতে গিয়ে কষ্ট সংবরণ করতে পারেননি। কেঁদে ফেলেন। বিভা রানীর সেই কান্না রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্বশীলদের কানে পৌঁছায় না। তিস্তার স্রোতের শব্দে সেখানেই মিলিয়ে যায়।

তীব্র স্রোতে ভাঙ্গছে তিস্তার পাড়। গত শুক্রবার বিদ্যানন্দের কালিরহাট বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শুধু বিভা রানী নন, তার প্রতিবেশী অনেকেই ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ ঘর ভেঙ্গে উপকরণ স্কুলের আঙ্গিনায় রেখেছেন, কেউবা অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বাড়ির বিছানাপত্র নিয়ে বাজারের দোকানের ভেতর অনিশ্চিত সংসার পেতেছেন।

গ্রামটির কয়েকশ মিটার এলাকাজুড়ে ভাঙ্গনের হুমকিতে দাঁড়িয়ে আছে শতাধিক পরিবার, কালিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা, পাকা সড়কসহ কালিরহাট বাজার। তিস্তা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে অনেক পরিবারের আঙ্গিনায় এসে পৌঁছেছে। যদি সর্বনাশা তিস্তার অনুগ্রহ হয়, যদি শেষ রক্ষা হয়, এমন আশায় অনেকে ভাঙ্গনের কিনারে অপেক্ষারত।

এমনই একটি পরিবার বানেশ্বর-ভারতী রানী দম্পতির। পাকা সড়কের কাছে তিস্তার ভাঙ্গনের মুখে থেকেও এখনও বসতি সরাননি। তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আঙ্গিনায় বসে কলা গাছের মজ্জা আর কাঁঠালের বীজ দিয়ে দুপুরে খাবারের তরকারি প্রস্তুত করছিলেন ভারতী। সেই দৃশ্য ভারতীদের আর্থিক সামথ্যের জানান দিচ্ছিল। পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতী বলেন, ‘অবস্থা খারাপ। নদী ভাঙ্গতেছে। অল্প এখনার জন্য আটক হয়া আছি। (নদী) দয়া করি যদি ফির ছাড়ি দেয়, এই আশায় আছি। না হইলে ঘর সরান লাগবে। কিন্তু জায়গা জমি নাই।’

দু-একদিনের মধ্যে ভাঙ্গন রোধে কাজ শুরু হবে, বলছে পাউবো। ভারতীর সঙ্গে কথা বলার সময় পাশ দিয়ে শো শো শব্দের তীব্র স্রোতে বয়ে চলছিল টইটম্বুর তিস্তা। নদীতীরের বাসিন্দারা অনেকে বসতি সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ গাছপালা কাটছেন, কেউবা ভাঙ্গনের কিনারে থাকা ক্ষেত থেকে পাট কেটে নিচ্ছেন। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, ‘ভাঙ্গন রক্ষায় কাজ শুরু হবে কবে?’

তিস্তাতীরের বাসিন্দা ফজলুল হক ঘরবাড়ি ভেঙ্গে ট্রাক্টরে করে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রবীণ এই বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা অসহায়। বাড়িঘর সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমি ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছি। এর আগে সাড়ে ৬ একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন ভিটাটাও যাচ্ছে। ভাঙ্গন রোধে আজ কাজ করে, কাল কাজ করে বলেও কাজ করছে না। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের এলাকাটা রক্ষা করেন। নাহলে কয়েকশ পরিবার বিলীন হয়ে যাবে।’

বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য সেফারুল ইসলাম বলেন, ‘তিস্তার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে একের পর এক পরিবারের বসতি বিলীন হচ্ছে। ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সোনার জুম্মা এলাকা থেকে মৌলভীপাড়া পর্যন্ত তীরবর্তী শতাধিক পরিবার ভাঙ্গনের হুমকিতে দাঁড়িয়ে আছে।’

যদি শেষ রক্ষা হয়, এমন আশায় অনেকে ভাঙ্গনের কিনারে অপেক্ষারত। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘তিস্তায় ভাঙ্গন চলছে। বিদ্যানন্দের কালিরহাট বাজারের ভাটির দিকে ভাঙ্গনের তীব্রতা বেশি। মন্ত্রী মহোদয়কে (পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী) বিষয়টি জানানোর পর প্রতিরক্ষা কাজের অনুমতি পাওয়া গেছে। আমরা আপাতত ২০০ মিটার স্থানজুড়ে জিও ব্যাগ ফেলবো। দু-একদিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে।’

তবে কত পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পর পাউবো ‘জরুরি প্রতিরক্ষা কাজ’ শুরু করবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।