প্রশান্তি ডেক্স ॥ রাস্তার অলিগলি দূর দূরান্তে কোথাও কোনও ময়লা-আবর্জনা নেই। তবুও থেমে থেমে বাতাসের সঙ্গে বের হচ্ছে বাজে দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। নাক চেপে হাঁটতে হচ্ছে তাদের। প্রশ্ন হলো সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার অনেক আগেই কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ করার পরও এই দুর্গন্ধ আসছে কোথা থেকে?
দুর্গন্ধের কারণ অনুসন্ধান করে নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা দেখেন, পানি অপসারিত হওয়ায় নর্দমায় কোরবানির পশুর লেজ, কান, শিং, নাড়িভুড়ি ইত্যাদি জমে আছে। সেখান থেকেই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পরে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নর্দমা থেকে সেসব বর্জ্য অপসারণ করেন এবং সেখানে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দেন।
ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ২৯ নং ওয়ার্ডের পোস্তা এলাকায়। পরিচ্ছন্নতার এ কাজে নেতৃত্ব দেওয়া সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমরা মেয়র মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের কোরবানির পশুর বর্জ্য নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই অপসারণ করেছি। বর্জ্য অপসারণের পর এলাকায় ও আশেপাশের সব জায়গায় ব্লিচিং পাউডারও ছিটিয়ে দিয়েছি। তবুও সেখানকার কয়েকজন বাসিন্দার অভিযোগ ছিল সেই এলাকায় গন্ধ যায়নি, ক্রমাগত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তীতে আমরা বেশ কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়ে এসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে কোথা থেকে সেই রহস্য উন্মোচন করি। আমরা দেখি কোরবানির পশুর সব ধরনের বর্জ্য পানি নিষ্কাশনের পথে মানে ড্রেনের মধ্যে জমে আছে। সেখান থেকেই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এগুলোর কারণে ড্রেনে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। পরবর্তীতে আমরা পোস্তা এলাকার ড্রেন থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ’ টন গরুর নাড়িভূড়ি, লেজ, চামড়া, কান, শিং ইত্যাদি বের করি।’
প্রশ্ন হলো ড্রেনে এসব ময়লা ফেললো কারা? অত্র এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার কাছে জানতে চাওয়া হলে সবাই সোজাসাপ্টা উত্তর দেন ‘ওই এলাকার চামড়া ব্যবসায়ীরা।’ প্রতি বছরই তারা ড্রেনের মধ্যে এসব বর্জ্য ফেলেন। পরবর্তীতে সিটি করপোরেশন এসব পরিষ্কার করে।
২৯ নং ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে পোস্তা এলাকায় যতো চামড়া ব্যবসায়ী আছেন সবাইকে তাদের চামড়ার উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলার জন্য বলা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই তারা চামড়া, লেজ, নাড়িভূড়ি এসব ড্রেনে ফেলছেন। সিটি করপোরেশন থেকে তাদের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে তারা যেন কোনও কিছু ড্রেনে না ফেলেন। কিন্তু তারা এসব আমলেই নিচ্ছেন না।’
নর্দমা থেকে চামড়া-লেজ-কান-শিং-নাড়িভুড়ি পরিষ্কারে কাজ করছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছনতাকর্মীরা। পোস্ত এলাকার বাসিন্দা সোহরাব হোসেন। পেশায় তিনি একটি হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ছাড়াও এলাকার যারা ঈদে কোরবানি দিয়েছেন তাদের অনেকে গরুর নাড়িভূড়ি ড্রেনে ফেলেছেন। তারা মূলত ব্যবসায়ীদের দেখাদেখি এসব বর্জ্য ড্রেনে ফেলেছেন। তারা ভেবেছিলেন ড্রেনে পানির স্রোতে বর্জ্য ভেসে চলে যাবে। কিন্তু চামড়া, নাড়িভূড়ি এগুলো যেখানে ফেলা হয়েছে সেখানেই পড়ে ছিল, বরং আরও পানি আটকে পুরো ড্রেনেজের নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে।’
২৯ নং ওয়ার্ডের পোস্তা এলাকার দুই জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়; যারা এবারের ঈদে কোরবানি দেননি। তাদের একজন পারভেজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘গরু যেখানে জবাই করছেন সবাই সেখানেই সব বর্জ্য রেখে গেছেন। কেউ আর ডাস্টবিনে বা নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলেননি। ফলে কোরবানির গরুর নাড়িভূড়ি বা অন্যান্য যেসব বর্জ্য সেসব রাস্তার পাশে ড্রেন ঘেঁষে রেখে গেছেন। সেখান থেকে ড্রেনে পড়েছে। আবার অনেকে ইচ্ছে করে সরাসরি ড্রেনের মধ্যে এসব ময়লা ফেলছেন। এখানকার চামড়া ব্যবসায়ীরা সরাসরি তাদের অপ্রয়োজনীয় সবকিছু বছরের পর বছর ড্রেনে ফেলে আসছেন। কেউ বাধা দিলেও শোনেন না।’
বর্জ্যের গন্ধে অতিষ্ঠ সেই এলাকার হাসান মাহবুব নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা শিক্ষিত হচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমাদের মাঝে সুশিক্ষার অভাব আছে। আমরা যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতাম তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কারে আমাদের অবদান থাকতো। ছোট ছোট কাজের দ্বারাও সমাজ সংস্কার হয়। আমরা উন্নত বিশ্বের দিকে তাকিয়ে অনেক ধরনের উদাহরণ দেই কিন্তু সেখানকার মানুষের সভ্যতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, একজন নাগরিক হিসেবে তারা কী দায়িত্ব পালন করছেন সেদিকে তাকাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব একটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সমাজ ও দেশ গঠনে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করা। কিন্তু আমরা তা কখনোই করি না। আমরা ভাবতে থাকি, রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য তো পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আছেই। এটা তো আমার কাজ না। আমার কাজ নোংরা করা। আর সরকার তো আছেই তারা যদি পরিষ্কার না করে তাহলে আর কে করবে। আমাদের কবে হুঁশ ফিরবে তা জানা নেই। তবে একজন মানুষ হিসেবে এমন মানসিকতার পরিবর্তন করা উচিত। এসবের জন্য সচেতনতার প্রয়োজন, পরিবার থেকে সন্তানদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা দরকার।’
রাজধানীকে সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে রাজধানীবাসীর দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত বলে মনে করেন নগরবিদরা। রাজধানী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘জনগণকে সচেতন করার বিভিন্ন উপায় আছে। যদি তাতেও কাজ না হয় তাহলে প্রয়োজনে শাস্তি বা জরিমানার ব্যবস্থা করে হলেও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এতে করে রাজধানী যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে তেমনি রাজধানীবাসী নিজেরাই এর সুফল ভোগ করতে পারবেন।’
সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করা সত্ত্বেও চামড়া ব্যবসায়ীরা কেন নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য না ফেলে ড্রেনে ফেলেন এমন প্রশ্নের জবাবে চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ এর সভাপতি আফতাব খান বলেন, ‘শুধু যে চামড়া ব্যবসায়ীরা ড্রেনে বর্জ্য ফেলে তা কিন্তু না, এই এলাকার আশেপাশের যারা আছে তারাও ফেলেন। একা চামড়া ব্যবসায়ীদের দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। আগে চামড়া ব্যবসায়ীরা ফেললেও এখন সেই হার ৯০ শতাংশ কমেছে। আমরা অস্বীকার করছি না যে চামড়া ব্যবসায়ীরা বর্জ্য ফেলেন না। কিছু সংখ্যক হয়তো ফেলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আমাদের চুক্তির পর প্রত্যেক ব্যবসায়ীর দোকানের সামনে বর্জ্য ফেলার জন্য বস্তা দেওয়া হয়েছে। সব ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে বস্তায় বর্জ্য ফেলার। এরপর যখন বস্তা ভরে যায় তখন হয়তো তারা রাস্তায় বা ড্রেনের পাশে রাখেন। আমি সতর্ক করে দিয়েছি যে কোনও ব্যবসায়ী যদি ড্রেনে বর্জ্য ফেলে তাহলে ম্যজিস্ট্রেট এনে তাদের জরিমানা করাবো।’