শিক্ষা ক্যাডারে বাড়ছে চাকরি ছাড়ার প্রবণতা

প্রশান্তি ডেক্স ॥ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করা যাচ্ছে না। ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার অভিযোগ তুলে আসছেন। এর মধ্যে বেশি বঞ্চনার অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে।  দীর্ঘদিন থেকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি দাবি জানিয়ে আসলেও বৈষম্য কমেনি। শুধু তাই নয়, শিক্ষা ক্যাডারদের চাকরি স্থায়ী হতে সময় লাগছে ৪ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত। ১৬ বছর পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া আটকে থাকার ঘটনাও আছে। সময়মতো পদোন্নতি না হওয়া নিয়েও আছে অসন্তোষ। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈষম্য চরম পর্যায়ে, তাই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।

শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা বলছেন, ২০১৮ সালের আগে জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকরা ক্যাডারভুক্ত হলেও চাকরি স্থায়ী হওয়ার ফাঁদে আটকে থাকতে হয়নি। আর শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা স্থায়ী না হওয়া পর্যন্ত পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে তারা পদমর্যাদায় জুনিয়র হিসেবে চাকরি করছেন। অপরদিকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদ না থাকলেও পদোন্নতি পাচ্ছেন। আর শিক্ষকরা শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতির জন্য অপেক্ষা করছেন বছরের পর বছর।

জানা যায়, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা চাকরির শেষের দিকে অধ্যাপক হওয়ার পরও একটি গাড়ি কেনার জন্য কোনও সহায়তা পাচ্ছেন  না সরকারের কাছ থেকে। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের একজন ডেপুটি সেক্রেটারিও সরকারের কাছ থেকে গাড়ি পাচ্ছেন, সঙ্গে মেনটেইনেন্স খরচও পাচ্ছেন। আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন করার দাবি জানিয়েও বছরের পর বছর কোনও সুবিধা করতে পারেননি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। ফলে অনেকে এই ক্যাডার ছেড়ে অন্য চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। চাকরি ছাড়ার জন্য পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন শত শত শিক্ষক।

বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তা নড়াইল সরকারি কলেজের আইসিটির প্রভাষক মো. আব্দুল কাইয়ুম হাওলাদার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারী পরিচালক পদে চাকরি নিয়ে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছেন। ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট তাকে শিক্ষা ক্যাডার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের গত ১০ জুনের আদেশে দেখা গেছে, মাধ্যমিকের ২৭ জন সহকারী শিক্ষক চাকরি ছাড়ার অনুমতি পেয়েছেন। স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি চাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অন্যত্র চাকরি, পারিবারিক কারণ ও ব্যক্তিগত কারণ। এই ২৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ১১ জন অন্যত্র চাকরি পাওয়ায় স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা ছেড়েছেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের গত ২২ এপ্রিলের আদেশে দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন বেশ কিছু শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ১২ জনকে একটি আদেশে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই ১২ জনের মধ্যে ৭ জন অন্যত্র চাকরি করার শর্তে অব্যাহতি পেয়েছেন। বাকিরা ব্যক্তিগত কারণ বা পারিবারিক কারণ দেখিয়ে চাকরি ছেড়েছেন।

এছাড়া, ২০২৩ সালের ২ আগস্ট অন্যত্র চাকরি পাওয়ায় অব্যাহতি পেয়েছেন ১৭ জন মাধ্যমিক শিক্ষক।

১৭ বছর পর চাকরি স্থায়ী : কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের আদেশে দেখা গেছে, ১৭ বছর পর ৭৮৬ কর্মকর্তাকে চাকরিতে স্থায়ী করা হয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসি ভোকেশনাল কোর্স প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৩টি নতুন ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পে তারা কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর তাদের স্থায়ী করা হয়।

২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করা ১৯৮ জনকে চাকরিতে স্থায়ী করা হয়। এদের চাকরি স্থায়ী হতে ৪  থেকে ৬ বছরের বেশি সময় লেগেছে।

চাকরি ছেড়ে বিদেশে: পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কারণের কথা বলে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়া কর্মকর্তাদের একটি অংশ দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছেন। দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থেকে দেশের বাইরে স্থায়ী হওয়ার পর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন অনেকেই। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

চাকরি ছাড়ার প্রস্তুতি: শিক্ষা ক্যাডারে চাকরিরত অবস্থায় প্রশাসন বা বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি পাওয়ার জন্য বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। অনেকে নন-ক্যাডারেও সুবিধাজনক চাকরি পেলে চলে যাচ্ছেন।

গত ৬ জুন শিক্ষা ক্যাডারের ৩৯ জন প্রভাষককে ৪৪তম বিসিএস ক্যাডারে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১ মার্চ মৌখিক পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয় ৩ জনকে। এর আগে ৪১তম ও ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার অংশগ্রহণের জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের বেশকিছু কর্মকর্তা।

আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ : ২০১৫ সালে বেতন স্কেল নিয়ে সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সে সময়ের মুখ্যসচিব, জনপ্রশাসন সচিব, অর্থসচিব ও শিক্ষা সচিব প্রকৌশলী-কৃষিবিদ ও চিকিৎসক (প্রকৃচি) এবং বিসিএস সমন্বয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে সব ক্যাডারের পদসোপান সুষমকরণের মাধ্যমে পদোন্নতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনায় কমিটি প্রধানত তিনটি বৈষম্য দূর করার জন্য কাজ শুরু করে।

এগুলো হচ্ছে- প্রতিটি ক্যাডারে একটি করে গ্রেড-১ পদ থাকতে হবে, সব ক্যাডারের কর্মকর্তা চতুর্থ গ্রেডের টাইম স্কেল পাবেন এবং সব ক্যাডারে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি দেওয়া হবে। এর মধ্যে প্রতিটি ক্যাডারে গ্রেড-১ পদ ও সব ক্যাডারে চতুর্থ গ্রেডের টাইমস্কেল নিয়ে আংশিক কাজ হলেও সুপারনিউমারারি পদোন্নতির বিষয়ে কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আটকে যায়। ২০১৭ সালে সচিব সভায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে প্রধানমন্ত্রী আবারও নির্দেশনা দেন। কিন্তু বৈষম্য কমানোর যথাযথ কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

অথচ পর্যাপ্ত পদ না থাকলেও অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদোন্নতি পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। বঞ্চিত হচ্ছেন অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

সমস্যা সমাধানে ২০১৭ সালের ২ জুলাই অনুষ্ঠিত সচিব সভায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে প্রধানমন্ত্রী আবারও নির্দেশনা দেন। কিন্তু কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বক্তব্য : বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান বলেন, ‘আমরা এমন কোনও দাবি করিনি, যা পূরণ করা অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর ২০৪১ সালের যে ভিশন তা যদি বাস্তবায়ন করতে চাই এবং নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থায় রেখে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। শিক্ষকদের মর্যাদা ও ন্যূনতম সুযোগসুবিধা অবশ্যই প্রয়োজন। শিক্ষকদের সম্মানের কথা মুখে বললেও কাগজে-কলমে শিক্ষকদের সম্মান নেই। বড় একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের বসার জন্য একটি চেয়ারও থাকে না।’

তানভীর হাসান বলেন, ‘অন্য ক্যাডারে পদোন্নতি হয় পঞ্চম গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেড। অথচ শিক্ষকদের হয় চতুর্থ গ্রেড। প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা যখন উপসচিব থেকে যখন যুগ্মসচিব হন, তখন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা পঞ্চম গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেড হন। কোন যুক্তিতে এই বৈষম্য করা হয়? টেকনিক্যাল এডুকেশনেও পঞ্চম থেকে চতুর্থ গ্রেডে পদোন্নতি হয়। শিক্ষকদের সুযোগ-সবিধার ক্ষেত্রেও তাই। আমি বলছি না যে, শিক্ষকদের গাড়ি-বাড়ি দেন। কিন্তু পদোন্নতি দিয়ে বেতনটা ঠিকঠাক মতো দেওয়া উচিত, যা নিশ্চিত করাও সম্ভব। উপজেলা পর্যায়ে অনেক কর্মকর্তার গাড়ি আছে। অথচ একজন অধ্যক্ষ জীবনের শেষ বয়সে কি গাড়ি পেতে পারেন না? সরকারের অবস্থা এত খারাপ না যে, শুধু শিক্ষকদের বেতন কম দিতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারে দ্বিতীয় গ্রেডের অনেক পদ আছে, আমাদের দ্বিতীয় গ্রেডে কোনও পদ নেই। তৃতীয় গ্রেডে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে একটিমাত্র পদ আছে। তবে পদ সৃষ্টি শুরু হয়েছে, দ্রুত সম্পন্ন কতে পারলে সমাধান হবে।’

শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের উপরিচালক মো. জাকির হোসাইন বলেন, ‘আন্তক্যাডার বৈষম্যের কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষক শিক্ষা ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে চলে যাচ্ছেন, এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কারণ মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট শিক্ষকের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। তাদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দফতর বা অধিদফতর শিক্ষা ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করা অসম্ভব।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বৈষম্য  দূর করতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় সাপোর্ট দেবে। যদি তা হয় তাহলে সমাধান হবে। প্রধানমন্ত্রী কমিটি গঠন করেছেন, অনুশাসনও দিয়েছেন, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারকে শক্তিশালী করা হচ্ছে না। ২০১০ সাল থেকে বিগত ১৫ বছরে কলেজে পদ সৃষ্টি হচ্ছে, পদ সৃষ্টি হবে শুনে আসছি, কিন্তু হয়নি। নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাষক পদ সৃষ্টি হলেও সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে না। কলেজের অধ্যক্ষরা অর্জিত ছুটিও পান না। এটা দীর্ঘ সময়ের দাবি হলেও সমস্যা সমাধান হয়নি। এখন বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সে কারণে যার সুযোগ আছে, তিনি অন্য চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। বাকিরা বাধ্য হয়েই অসন্তোষ নিয়ে চাকরি করছেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.