প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ কলকাতার বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছেন ৪ হাজার ৭০০ জন। দ্য ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালের সমীক্ষায় এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, ভারতের ১০টি শহরে বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ৩৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ওই ১০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বায়ুদূষণের কারণে দৈনিক মৃত্যুর হার ৭ শতাংশেরও বেশি। এই তালিকায় রয়েছে কলকাতা, আহমেদাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দরাবাদ, মুম্বাই, পুনে, সিমলা, এবং বারাণসী।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুর নিরিখে দিল্লি শীর্ষে, যেখানে প্রতি বছর ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। মুম্বাইয়ে এই সংখ্যা ৫ হাজার ১০০। কলকাতায় বছরে বায়ুদূষণের কারণে ৪ হাজার ৭০০ জন মারা যান, চেন্নাইয়ে ২ হাজার ৯০০, বেঙ্গালুরুতে ২ হাজার ১০০ এবং বারাণসীতে ৮৩০ জন। তালিকায় সবচেয়ে নিচে রয়েছে সিমলা, যেখানে বছরে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে কম, মাত্র ৫৯।
১৪ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যা নিয়ে ভারতের বৃহত্তম মেট্রো শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম কলকাতা। গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটির ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৯ সালে কলকাতা ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত শহর।
এমডিপিআই-এর ২০১৭ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে, কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ব্যাপক জ্বালানি ব্যবহার শহরের বায়ুদূষণের মূল কারণ। কলকাতায় রাস্তায় মোট জায়গার মাত্র ৬ শতাংশ রয়েছে, যা যানবাহনের গড় গতি কমিয়ে দেয় এবং যানজটে নির্গত ধোঁয়া দূষণ বাড়িয়ে তোলে।
২০১৭ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কলকাতায় চলা যানবাহনের সংখ্যা প্রতি বছর ৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ-এ প্রকাশিত ২০২২ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, উত্তর-পূর্ব ভারতের বাইরের শহরগুলোর মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের সর্বোচ্চ হারে এগিয়ে রয়েছে কলকাতা। পুরুষদের মধ্যে কলকাতায় ফুসফুসের ক্যান্সারের হার ২২, দিল্লিতে ১১.৮, চেন্নাইয়ে ১১.৮ এবং মুম্বাইয়ে ৯.৫। অন্যদিকে, নারীদের ক্ষেত্রে কলকাতায় এই হার ৭.০, যেখানে দিল্লিতে ৪.০, চেন্নাই ও মুম্বাইতে যথাক্রমে ৪.৭ ও ৬.০।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বায়ুদূষণজনিত কারণে ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুসারে, বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণার (পিএম ২.৫) মাত্রা ডব্লিউএইচও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় ১৭ গুণ বেশি। বিষ-বাষ্প যেমন ফুসফুসসহ সারা শরীরের ক্ষতি করছে, তেমনই বায়ুদূষণ থেকে বাড়ছে মানসিক ব্যাধিও।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের অধীন মিলকেন ইনস্টিটিউট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে কলকাতার বাতাসে অতি ক্ষুদ্র দূষক বা পিএম ২.৫-এর গড় পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৮৪ মাইক্রোগ্রাম, যা কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার ১৭ গুণ।
ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি) ২০১৯ সালে জানিয়েছিল, কলকাতার বাতাসে বছরে ৪ হাজার ৫৪ মেট্রিক টন সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা পিএম ২.৫ ভাসমান থাকে। এই দূষকের তিনটি মূল উৎস হলো গৃহস্থালি (২৮ শতাংশ), রাস্তার ধুলো (২৫ শতাংশ) এবং গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া (২৪ শতাংশ)। শিল্পের অবদান মাত্র ৭ শতাংশ, খোলা স্থানে কয়লা বা কাঠ পোড়ানোর জন্য দূষণ বাড়ে আরও ৭ শতাংশ।বায়ুদূষণ ঠেকাতে ইতোমধ্যে কলকাতাসহ রাজ্যের ছয়টি শহরের জন্য ‘এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ তৈরি হয়েছে। আটটি সরকারি দফতরকে কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো বন্ধ করতে উপগ্রহ নির্ভর নজরদারি শুরু হয়েছে, শীতকালে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে ধুলো কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। রাস্তার ধারের হোটেলগুলোকে কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণ দফতর ‘ইলেকট্রিক বাস’ চালানো শুরু করেছে।