প্রশান্তি ডেক্স ॥ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু এই চার নদী ঘিরে রেখেছে রাজধানী ঢাকাকে। এই নদীগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন খাল জালের মতো ছড়িয়ে আছে রাজধানীর বুকে। ২০১৬ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় খালের সংখ্যা ৫৮টি। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের হিসাবে এই সংখ্যা অন্তত ৬৯টি। তবে বাস্তবে এখন আর অস্তিত্ব নেই অনেক খালের। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখল ও দূষণসহ নানান অবহেলায় হারিয়ে গেছে এসব খালের অধিকাংশ।
ঢাকার এই খালগুলোর বেশিরভাগের মালিক গণপূর্ত অধিদফতর। প্রথমে ঢাকা ওয়াসাকে এসব খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে তা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই খাল উদ্ধারে মনোযোগী হয় দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে খালের পূর্বের রূপ ফিরিয়ে আনতে সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু হয়। এই কাজে অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশের পর থেকে রাজধানীর খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছিল ঢাকা ওয়াসা। তবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ওয়াসার বাৎসরিক জরিপেই খালগুলোর আকার ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে আসার তথ্য উঠে আসে। ওয়াসার পক্ষ থেকে গণপূর্তকে জানানো হয়, সীমানা নির্ধারণ করে না দেওয়ায় এই খালগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে।
পরবর্তীতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরে ওয়াসা থেকে ২৬টি খাল ও একটি জলাশয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছ থেকে আরও ১৪টি খাল বুঝে পায় দুই সিটি করপোরেশন। পরে আরও কিছু খালের খোঁজ পায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে দুই সিটির মধ্যে ৬৯টি খালের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে এর মধ্যে অনেক খাল বিলীন। যেসব খালের অস্তিত্ব এখনও আছে, তার মধ্যে ডিএনসিসি’র তত্ত্বাবধানে রয়েছে ২৯টি খাল ও একটি জলাশয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতায় রয়েছে ১১টি খাল। পরে নিজ আওতাধীন এলাকায় আরও ১৪টি খালের সন্ধান পায় এই সংস্থাটি, যা মিলিয়ে ডিএসসিসির খালের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫টিতে।
এছাড়াও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) এলাকার আরও ১৪টি খাল দক্ষিণ সিটিতে যুক্ত হওয়ার কথা চলছে, যেগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। ইতোমধ্যে খালগুলোও সিটি করপোরেশনে হস্তান্তরের জন্য কয়েক দফা মিটিংও হয়েছে।
এদিকে ডিএনসিসি খালের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর সীমানা নির্ধারণের কাজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেয়। তবে কোন রেকর্ড ধরে সীমানা নির্ধারণ করা হবে তা নিয়ে প্রথমে জটিলতা তৈরি হয়। পরে কোথাও সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে), কোথাও রিভিশনাল সার্ভে (আরএস) এবং কোথাও মহানগর জরিপ ধরে খালের সীমানা নির্ধারণ করা হয়।
ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছিলেন সিএস দাগ অনুযায়ী সব খালের সীমানা নির্ধারণের। তার নির্দেশের পর সঠিকভাবে খালের সীমানা নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয় ডিএনসিসি থেকে। এ কমিটির সিদ্ধান্তে সীমানা নির্ধারণের কাজ চলছে।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, ২৯টি খালের সর্বমোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৪ কিলোমিটার। এসব খালের প্রত্যেকটিতে কম-বেশি সীমানা পিলার বসানো হয়েছে। এর মধ্যে সিএস দাগ অনুযায়ী ৬৯৬টি, আরএস দাগ অনুযায়ী ১০৫টি, বিডিএস (বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে) দাগ অনুযায়ী ৫২টি, ওয়াসা নির্ধারিত ১২২টি ও অন্যান্য দাগ অনুযায়ী ৫টি সীমানা পিলার মিলিয়ে মোট ৯৮০টি সীমানা পিলার বসানো হয়েছে। এখনও পিলার বসানোর কাজ চলমান। এছাড়া কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ডে ওয়াটার ইকোপার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএনসিসি।
ডিএনসিসির ২৯টি খাল ও একটি জলাশয় হলো- মোহাম্মদপুর থানার অধীনে কাটাসুর খাল ও রামচন্দ্রপুর খাল; মিরপুর থানার অধীনে কল্যাণপুর প্রধান খাল, কল্যাণপুর ক, খ, ঘ, ঙ ও চ খাল। কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ড। পল্লবী থানার অধীনে আছে রূপনগর প্রধান খাল, আরামবাগে রূপনগর শাখা খাল, রূপনগর শাখা খাল-দুয়ারীপাড়া, রূপনগর শাখা খাল-চিড়িয়াখানা, বাউনিয়া খাল, দ্বিগুণ খাল, বাইশটেকি খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল। উত্তরা থানার অধীনে মিরপুর দিয়াবাড়ী খাল, উত্তর দিয়াবাড়ী খাল, আব্দুল্লাহপুর খাল, গোবিন্দপুর খাল। ক্যান্টনমেন্ট থানার অধীনে ইব্রাহিমপুর খাল। রমনা থানার অধীনে মহাখালী খাল। গুলশান থানার অধীনে শাহজাদপুর খাল, ডুমিনি খাল, বোয়ালিয়া খাল, কসাইবাড়ি খাল, সুতিভোলা খাল। ডেমরা ও সবুজবাগ থানার অধীনে বেগুনবাড়ি খাল ও নরাই খাল।
এদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঢাকা ওয়াসা থেকে ৯টি ও অন্যান্য সংস্থা থেকে ২টি খাল বুঝে পেলেও পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগে আরও ১৪টি খাল চিহ্নিত করে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চারটি খালু কালুনগর, শ্যামপুর, জিরানি ও মান্ডা খাল পুনরায় উদ্ধার ও আধুনিকায়নে ২০২২ সালের অক্টোবরে ৮৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার, যার কাজ শিগগিরই শুরু হবে বলে জানায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অন্যান্য খালে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে বলে জানায় সংস্থাটি। তবে সীমানা নির্ধারণের কাজে তেমন অগ্রগতি নেই এই সিটি করপোরেশনের।
ঢাক দক্ষিণ সিটির খালগুলোর মধ্যে রয়েছে- এসডিসি-১, এমডিসি-২, এসডিসি-৩ খাল, এসডিসি-৪ খাল, পাগলা শাখা খাল, ডিএল-১ খাল, ডিএল-২ খাল, ডিএল-৩ খাল, ডিএল-৪ খাল, এল-১ খাল, আর-১ খাল, কুতুবখালী খাল, মৃধাবাড়ি খাল। এর বাইরে আরও কিছু খাল আছে।
খালের সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, খালের সীমানা নির্ধারণে ৯৮০টি পিলার বসানো হয়েছে সর্বশেষ তথ্যমতে। আমাদের আরও ১৬০০ সীমানা পিলার বসানো হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কাজটি করছে। যথাসময়েই কাজটি সম্পন্ন হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। সীমানা নির্ধারণ হলে খালের সংস্কার কাজ করা সহজ হবে। তখন খালের পাড় বাঁধাইসহ পাশ দিয়ে নান্দনিক সড়ক ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা রাখা হবে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান ও প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, খালের বিষয়ে দক্ষিণ সিটির সফলতা হলো আমাদের ১১টি খাল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা নিজ উদ্যোগে আরও বেশ কয়েকটি খাল চিহ্নিত করে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এছাড়া দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান চারটি খাল প্রকল্পের আওতায় সংস্কার করা হবে। অতি দ্রুত এই কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।