বাংলাদেশ-চীন: সম্পর্কের নতুন অধ্যায় ও ভবিষ্যৎ

বাআ॥ চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল লি শিয়াংয়ের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সরকারি সফরে বেইজিংয়ে আছেন। কূটনীতিক আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে এই সফরের মধ্য দিয়ে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সফরের লক্ষ্য দেশের উন্নয়নে আরও বিনিয়োগ এবং ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করা। আর তাই এই সফরকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় এ সফরে কোনো চুক্তি সই হবে না। তবে ২০টি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। তবে ২০১৪ সালের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে যে কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়েছেন তেমনটি এবারও হলে বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য আরও ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। ওই বছর প্রধানমন্ত্রী প্রচলিত কূটনীতির বাইরে গিয়ে চীনকে কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু টানেল অর্থায়নে ফিরিয়ে আনেন এবং চুক্তি করেন। যদিও এ নিয়ে চীন শুরুতে কিছুটা গড়িমসি করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সরাসরি অনুমোদনে শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার মুখ দেখে কর্ণফুলী টানেল, যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যন্য এক অর্জন হয়ে আছে।

২০১০ এবং ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর দুই দেশের মধ্যে বর্তমান উষ্ণ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছে। ওই সফরে দুই দেশ প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ২১টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর আন্ডারওয়াটার টানেল ইত্যাদির মতো বড় প্রকল্পে সহযোগিতা করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে ২১টি সেতু, ১১ টি মহাসড়ক নির্মাণে সহায়তা করেছে। এছাড়া ২৭টি জ্বালানি শক্তি ও বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ অসংখ্য অসংখ্য প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে চীন।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যও বেড়ে চলেছে। চীন ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা কার্যকর করেছে। পরে, তা বাড়িয়ে ৯৮ শতাংশ করা হয়।

২০২২-২৩ অর্থবছরে, চীন বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ছিল, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৭ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার মিলিয়ন এবং আমদানির পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া গত চার বছরে চীন থেকে বাংলাদেশ তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ সাত বিলিয়ন ডলার।

এ ছাড়াও এবারে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় তিস্তা মহাপরিকল্পনা। ভারত সফরের মাধ্যমে এই কার্যক্রমে এরই মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির একটি টেকনিক্যাল টিম বাংলাদেশ সফর ও পরবর্তীতে এই প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনার মূল ট্যাকনিক্যাল আলোচনা এর আগেই করা হয় চীনের সঙ্গে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পের নাম তিস্তা সেচ প্রকল্প। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা হবে। যার মাধ্যমে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানি আর প্রয়োজন পড়বে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বাড়বে। বন্যার পানি প্লাবিত হয়ে ভাসাবে না গ্রামগঞ্জের জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যাবে। এতে আছে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুপাশে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষি জমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। নৌবন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে প্রকল্পে। তিস্তার দু’পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থা, মাছ চাষ প্রকল্প, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন নামে একটি প্রকল্প। তিস্তা নদীরপাড়ের জেলাগুলো নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় এরই মধ্যে এ বিষয়ক চীনের ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ শুরু করেছে। সুতরাং নিশ্চিতভাবেই চীনের সঙ্গে এ বিষয়ক বিস্তর আলোচনার আশা করছে তিস্তা পারের অধিবাসীরা।

বিশ্লেষকদের মতে, বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে চীনের সাথে স্মার্টভাবে জড়িত থাকার মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া মার্কিন ডলার মূল্যের চলমান প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ বিলম্ব করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ কমবে বাংলাদেশে। আর তাই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার এমন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেব দেখছেন তারা।

বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ -চীন সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। এর ফলে চীনের সঙ্গে রফতানি বহুমুখীকরণ এবং সম্ভাব্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সহ আলোচনার জন্য নতুন পথ খোলা হয়। আশা করা হচ্ছে এবারের সফরে প্রধানমন্ত্রী নতুন কোন চমক নিয়েই দেশে ফিরবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.