আন্দোলন-সংঘাতে: অর্থনীতির ক্ষতি কত?

প্রশান্তি ডেক্স॥ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিনে নাশকতার ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা দেশে। দেশজুড়ে সন্ত্রাসীদের হামলা, লুটপাট ছাড়াও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় অর্থনীতিতে ভয়াবহ ক্ষতির প্রভাব পড়েছে। ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে গোটা ই-কমার্স খাত। এ ছাড়া দ্রুতগতির ফোরজি ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ থাকায় ইন্টারনেটভিত্তিক মোবাইল আর্থিকসেবাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। সবমিলিয়ে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে।

বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়াও দেশে  মোবাইল ব্যাংকিংসহ সব ধরনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। সংকট তৈরি হয় বৈদেশিক বাণিজ্যেও। বিশেষ করে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে বিশ্বের সঙ্গে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এতে ইন্টারনেটভিত্তিক লেনদেনে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।  গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) থেকে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ ছিল। আমদানি-রফতানি প্রায় বন্ধ। বন্দর থেকে আমদানি পণ্য ছাড় করা যায়নি। বিদেশি অর্ডার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রফতানিকারকরা। অচল হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের কাস্টমস শুল্কায়ন কার্যক্রম। গত পাঁচ দিনে প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমস।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আর্থিকভাবে বাংলাদেশের যতটা না ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ইমেজের। তারা বলছেন,  বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবন, মেট্রোরেলসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুন্ন হয়েছে। এছাড়া গত কয়েকদিনের আন্দোলন-সংঘাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি আব্দুল মান্নান কচি বলেন,  আর্থিক ক্ষতির চেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হয়েছে বেশি। তিনি জানান, এই কয়েক দিনের স্থবিরতায় প্রায়  ১১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ’র সরাসরি রফতানিতে ক্ষতি হয়েছে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। শ্রমিকদের বসিয়ে বেতন দিতে হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এছাড়া এক্সেসরিজ, বোতাম, সুতা খাতে লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অবশ্য রফতানি অর্ডার এই কয়েকদিনে কী পরিমাণ কমেছে, তা তিনি বলেননি। আব্দুল মান্নান কচি মনে করেন, এই ঘটনায়  বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চিনলো অন্যভাবে। এতে বিশ্বব্যাপী আমাদের যে সুনাম ছিল, তা নষ্ট হয়ে গেলো।

এ প্রসঙ্গে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের ইমেজকে নষ্ট করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। বিটিভি ভবন ও মেট্রোরেলের হামলাকে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণিত ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে দিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে ছোট করা হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিজিএমইএ’র ক্ষতির কাছাকাছি ক্ষতি হয়েছে পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বিকেএমএ’রও। এছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎপাদনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কী পরিমাণ অর্ডার এসেছে  বা বাতিল হয়েছে, কিছুই জানা সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি কারখানায় ভাংচুর করা হয়েছে। এতে কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।  একদিন কারখানা বন্ধ থাকলে ১৬ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়, যা দেশীয় মুদ্রায় ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রফতানিমুখী অর্থনীতি। ইন্টারনেট পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় এলসি খোলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, গত সাত দিন আগে তিনটি এলসি দিয়ে রেখেছি, একটিও ওপেন হয়নি। গত (বুধবার) সকালে ব্যাংকে কথা বললাম, ব্যাংক জানালো তারা চেষ্টা করছে।

এদিকে ব্যাংকাররা জানান, দেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর। আমদানি-রফতানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ই-মেইলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে ই-মেইলে প্রয়োজনীয় নথিপত্রও পাঠাতে হয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ব্যাংক ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এ কারণে নতুন  এলসি খোলা যাচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অর্থনীতির ক্ষতি বেশি হচ্ছে। তাদের হিসাবে, গত এক সপ্তাহে ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশির যার দায় বহন করতে হবে সরকার, বেসরকারি খাত ও সাধারণ মানুষকে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন গত এক সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তার মতে, চলমান স্থবিরতায় দিনে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, অর্থনীতির এই ক্ষতির কারণে সরকারের সরাসরি আয় কমে যাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, মানুষের আয় যেমন কমছে, সরকারের আয় তেমেই কমছে। এছাড়া মূল্যস্ফিতির পরিস্থিতি  আরও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ফিরেছে বলে মনে করেন তিনি।

চলমান ছাত্র আন্দোলনে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তত হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দফতর-কার্যালয়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, হামলা-অগ্নিসংযোগে শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও বিটিভিরই কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) সকাল সাড়ে ৮টা থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমস অফিসের অভ্যন্তরীণ কম্পিউটারগুলোয় অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড (পণ্যের আমদানি-রফতানির আধুনিক শুল্কায়ন পদ্ধতির আন্তর্জাতিক সফটওয়্যার) চালু করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে। আর তা শুধু চট্টগ্রাম কাস্টমসের কাছে সীমাবদ্ধ থাকায় নতুন কোনও পণ্য অন্তর্ভুক্তি করা যাচ্ছে না। ফলে পণ্যের জাহাজিকরণ এখনও বন্ধ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, দেশব্যাপী ইন্টারনেট না থাকায় গত বৃহস্পতিবার (১৮জুলাই) রাত থেকে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে পরদিন শুক্রবার থেকে। চট্টগ্রাম কাস্টমস এই বন্দর থেকে গত জুনে ৬ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা, মে মাসে ৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। গড় হিসাবে প্রতি মাসে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। প্রতিদিন গড়ে ২১৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। এই হিসাবে পাঁচ দিনে (শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার) ১ হাজার ৮৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস।

বন্দর সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হয়ে থাকে। প্রতি কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে বন্দরের চার্জ ৪৫ মার্কিন ডলার। সেই হিসাবে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে বন্দরের রাজস্ব আদায় হয় ৪ লাখ ৫ হাজার মার্কিন ডলার (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসাবে ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা)। বর্তমানে রফতানিপণ্য জাহাজিকরণ হতে না পারায় কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে এক দিনে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বাবদ বন্দরের আয় কমেছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ও বাল্ক পণ্যেও প্রায় সমপরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে। ফলে প্রতিদিন বন্দরের আয় কমেছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। গত পাঁচ দিনে এই সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি টাকা হতে পারে।  পাঁচ দিনে বন্দর ও কাস্টমসের ক্ষতি প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.