প্রশান্তি ডেক্স॥ কোটা আন্দোলনকে ঘিরে রংপুরে নারকীয় তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘটনাস্থল গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) দুপুরে পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এরপর তিনি এসে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। এ সময় তিনি রংপুর জেলা, মহানগর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দলের নেতাকর্মীদের ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আপনারা ফেল (ব্যর্থ) করেছেন। ওরা এসে অফিসে হামলা করলো, আগুন ধরিয়ে দিল আর আপনারা পকেটে হাত দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে ওরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে মেরে ফেলবে। এখনই সাবধান হয়ে যান। দলের মধ্যে দুর্বলতাগুলো দূর করেন।’
সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য দেওয়ার সময় রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বার বার বিভিন্ন দাবি দাওয়া উত্থাপন রংপুর সিটি মেয়র জাতীয় পার্টির নেতা মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কষ্ট হয়, আপনাদের পার্টি অফিস যখন ভাংচুর করলো, তখন আপনারা নাই। অথচ পার্টি অফিস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ভিডিওতে দেখা গেলো মাত্র কয়েকজন এইরকম ঘটনা ঘটিয়েছে। আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড়াতে হব। কেননা আমরা বীরের জাতি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে খালি হাতে আমরা শুধু জয় বাংলা ে¯্লাগান দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি।’
রংপুরে আওয়ামী লীগের করুণ দশার কথার সূচনা করেন রংপুর-৪ আসনের এমপি সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রথমে বক্তব্য দিতে আসেন রংপুরের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি নাসিমা জামান ববি। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকা নেতাকর্মীদের খুঁজে বের করতে হচ্ছে। রংপুরে আমাদের দলের সাংগঠনিক ব্যর্থতা আর দুর্বলতা খুঁজে বের করা দরকার।’
তিনি রংপুর সিটি মেয়র ও জাতীয় পার্টির মহানগর সভাপতি, দলের কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করেন, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে অরাজকতার সময় জাতীয় পার্টির অনেক নেতাকর্মীকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশ নিতে দেখা গেছে। এ জন্য সিটি মেয়রকে জবাবদিহি করতে হবে। ওই সময় অনেক ঘটনায় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের এক লাইনে দেখলাম। আইনের হাত কিন্তু অনেক লম্বা। তবে এটা সত্যি আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি।’
রংপুর-৪ আসনের এমপি টিপু মুনশি বক্তব্য দিতে এসেই রংপুর মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধুয়ে দিলেন। তিনি বলেন, ‘রংপুরে আওয়ামী লীগ কেন এত দুর্বল হয়ে গেলো? কেন আমাদের রক্ষা করতে পুলিশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমরা কেন নিজেদের শক্তি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশের ওপর ভরসা করলাম। আমাদের অবস্থা এতটাই করুণ কেন হলো? ভিডিওতে দেখলাম ১০/১২ যুবক জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা করে ভাংচুর করে আসবাবপত্র ভেঙে ফেলে আগুন ধরিয়ে দিলো। কেন আমরা তাদের প্রতিরোধ করতে পারলাম না। আমার মনে হয় রংপুরের এই আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগ নাই। রংপুরে প্রথম শহীদ রনি রহমানসহ আমরা যুদ্ধ করেছি।’
রংপুর সিটি মেয়র মোস্তফাকে দায়ী করে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে হ্যারাস (হয়রানি) করতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘এবার আমাদের দলের যে চেহারা দেখলাম, এ ধাক্কা যেন শেষ ধাক্কা হয়। দলকে শক্তিশালী করা দরকার। ২০টা মানুষ আমাদের পার্টি অফিস হামলা করে জ্বালিয়ে দিলো। আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখা দরকার। আমার নিশ্চয় এ প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে পারবো।’
টিপু মুনশি বক্তব্য দেওয়ার সময় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মুখ লুকাতে দেখা গেছে। এ সময় হলে উপস্থিত অনেক নেতাকর্মী হাত তালি দিয়ে তার বক্তব্যকে স্বাগত জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য দেওয়ার সময় নেতাকর্মীরা বার বার সিটি মেয়রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এবার যারাই আন্দোলনের নামে অরাজকতা করেছে, সহযোগিতা করেছে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
তার এই বক্তব্যের পরও আবারও ২/৪ জন নেতা কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি বলেন, ‘রংপুরে মহানগর জেলা আওয়ামী লীগের অফিসে হামলা হলো আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো আপনারা কী করেছেন? আপনারা ফেল করেছেন। ১০/১২ জন মিলে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আগুন দিলো, তান্ডব চালালো আপনারা কেন প্রতিরোধ করতে পারলেন না?’
এ সময় কয়েকজন নেতা দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন রংপুর মহানগর আর জেলা আহ্বায়ক কমিটি ভেঙ্গে দেন- এরা ব্যর্থ এদের নেতারা পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এসব দেখবেন’। এরপরও অনেকেই মন্ত্রী বক্তব্য দেওয়ার সময় বিভিন্ন কথা বার্তা বলে বাধার সৃষ্টি করছিলেন।
এ সময় তিনি বলেন, ‘আপনাদের কাজ আপনারা করেন। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ। তিনি ঠিক করবেন ভবিষ্যতে রংপুরের রাজনীতি কীভাবে করতে হবে। আপনারা আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। যার বিরুদ্ধে বলছেন, তখন কি কোমরে হাত রেখে বসে ছিলেন? আসলে আপনারা ফেল করেছেন।’
মন্ত্রী বলেন, ‘রংপুরসহ সারা দেশে যারা নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে, সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’
মন্ত্রীর বক্তৃতার সময় বিভিন্নভাবে নেতাকর্মীরা কথা বলায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ফলে সভা চলাকালে এবং সভার পরে যাওয়ার সময় কোনও নেতার সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখা যায়নি।
সভায় রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ডা. দেলোয়ার হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাশেম, সাবেক সভাপতি শাফিয়ার রহমান, সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডল, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহামেদ, জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক ছায়েদুল হক বকুলসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।