প্রশান্তি ডেক্স ॥ মাসুরা বেগমের শারীরিক উচ্চতা মাত্র ৩৮ ইঞ্চি। প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে গড়েছেন সংসার, হয়েছেন ‘মা’। জীবন সংগ্রামে উদ্যমী ও আত্মবিশ্বাসী মাসুরা বেগম রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বজরপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার জীবনের গল্প আলোচিত ও আলোড়িত হয়েছে দেশের অনেক গণমাধ্যমে। এরপর বিষয়টি রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদের নজরে আসে। তিনি মাসুরার কাছ থেকে নিজের একটি বাড়ি ও দোকানের স্বপ্নের কথা জানতে পারেন।
এরই ফলশ্রুতিতে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পেয়েছেন মুজিববর্ষের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তার গ্রামেই একটি সুন্দর পাকা বাড়ি। গত মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মাসুরার দোকানের স্বপ্নও পূরণ হলো। তাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি দৃষ্টিনন্দন দোকান করে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক ও রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহমেদ।
এদিন সকালে পারিলা ইউনিয়নের বজরপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ফলক উন্মোচন ও দোয়া মাহফিলের মাধ্যমে এ দোকানঘরের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। মাসুরার দোকানের প্রথম ক্রেতাও ছিলেন তিনি। প্রথম ক্রেতা হিসাবে তিনি বেশকিছু চকলেটের বক্স কেনেন এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের শিশুদের মাঝে এগুলো বিতরণ করেন।
এ সময় জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘মাসুরা এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মা। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে আমার নজরে আসে। এরপর আমি তাকে নিজ কার্যালয়ে দাওয়াত দেই। কথা বলে বাড়ি ও দোকানের স্বপ্নের কথা জানতে পারি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মুজিববর্ষের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তার গ্রামেই একটি সুন্দর পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে মাসুরার মতো অনেক সুবিধাবঞ্চিত মানুষ সহযোগিতা পেয়েছেন। তাই মাসুরার দোকানের স্বপ্ন পূরণে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন এগিয়ে এসেছে।’
মাত্র ৩৮ ইঞ্চি (৩ ফুট ২ ইঞ্চি) উচ্চতা নিয়েও মা হয়েছেন মাসুরা বেগম। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসবের সময় পর্যন্ত তাকে যে দুই জন চিকিৎসক দেখেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন তাদের দাবি, উচ্চতার হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং এশিয়ার ক্ষুদ্রতম মা এই মাসুরা বেগম।
জানা যায়, উচ্চতার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মা ২৮ ইঞ্চি উচ্চতার আমেরিকার স্টেসি হেরাল্ড। ২০০৬ সালে প্রথম সন্তান প্রসব করেন তিনি। তিন সন্তান প্রসবের পর ২০১৮ সালে মারা যান স্টেসি হেরাল্ড। ভারতের গণমাধ্যমের দাবি, ৪১ ইঞ্চি উচ্চতার ভারতের কামাক্ষি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম উচ্চতার মা। যিনি ২০১১ সালে সফলভাবে বাচ্চা প্রসব করেন। রাজশাহীর মাসুরা বেগমের উচ্চতা কামাক্ষির চেয়েও তিন ইঞ্চি কম। মাসুরা সফলভাবে মা হয়েছেন ২০১৩ সালে।
রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর এলাকায় কাজের জন্য আসেন গাইবান্ধার মনিরুল ইসলাম। ২০০৩ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন মাসুরা বেগমকে। প্রায় ১০ বছর পর ২০১৩ সালে মাসুরা বেগম একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। গর্ভকালীন শতকষ্টেও মাসুরার পাশে ছিলেন মনিরুল। গর্ভধারণের আট মাস ১০ দিন পর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে প্রায় আড়াই কেজি ওজনের কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।
মাসুরার ১১ বছরের কন্যা মরিয়ম ইতোমধ্যে উচ্চতায় মাকে ছাড়িয়ে ৪১ ইঞ্চি উচ্চতায় পৌঁছেছে। মা-মেয়ের ভালোবাসাও বেশ। এই বয়সেই মাকে নানা কাজে সহযোগিতা করে মরিয়ম। এবার মরিয়ম পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। মাসুরা বেগমের চিকিৎসক ছিলেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক ডা. হাসিনা আক্তার ও আবাসিক সার্জন নুরে আতিয়া লাভলী। তাদের দাবি, এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম মা এই মাসুরা বেগম।
মাসুরা বেগমের স্বামী মনিরুল ইসলাম জানান, প্রায় দেড় যুগ ধরে মাসুরার সঙ্গে ঘর বেঁধে সুখে সংসার করছেন। শারীরিক যোগ্যতা নয়, ভালোবাসা এবং ভালো থাকার জন্য প্রয়োজন সুন্দর মন।
নিজ হাতে দোকানটি সাজান মাসুরা। মাসুরার ভাষ্য, ‘আমি উচ্চতায় খাটো। এজন্য মানুষ আমাকে অনেক সময় খোঁটা দিয়েছে। তবে অনেকের ভালোবাসাও পেয়েছি। জেলা প্রশাসকের মতো ব্যক্তি আমার দোকান থেকে পণ্য ক্রয় করলেন। সবার দোয়ায় আল্লাহর রহমতে স্বামী-সংসার নিয়ে ভালোই আছি।’
পবা উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দোকান উদ্বোধনের কথা জানতে পেরে আবেগ আপ্লুত হয়ে রাত জেগে বিভিন্ন রঙের বেলুন এবং রঙিন কাগজ-কাপড় দিয়ে নিজ হাতে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন সাজে স্বপ্নের দোকানটি সাজান মাসুরা। সঙ্গে ছিলেন স্বামী ও কন্যা।
দোকান পেয়ে উৎফুল্ল মাসুরা বলেন, ‘আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল নিজের একটি বাড়ি ও দোকানের। আমি অলস বসে থাকতে চাই না, চাই পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হতে। আমার স্বামী ভ্যান চালিয়ে যা আয় করে, তা দিয়ে সংসার চলে না। দীর্ঘদিন থেকে গরু, ছাগল ও মুরগি পালন করে অনেক কষ্টে সংসার চালাচ্ছি। পাশাপাশি একটা দোকান থাকলে পরিবারের অনেক উপকার হতো। আমার জীবনের কষ্টের কথা শোনার পর বাড়ি ও দোকানের স্বপ্ন পূরণ করেছেন ডিসি স্যার। আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।’ মাসুরা আরও বলেন, ‘আমার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এই দোকানের মাধ্যমে আমার পরিবারের সব অভাব অনটন দূর করবো ইনশাআল্লাহ।’