জেলখানার দিনগুলি

আমার পকেটে ৩৫০০ টাকা ছিল। বেল্ট, আংটিসহ সবই খুলে দিলাম। যতœ করে রাখার জন্য জনাব কামরুজ্জামান সাহেবকে অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি আংটির বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। তারপরও আল্লাহর উপর বিশ্বাস করে জমা দিলাম লকাপে। যাতের করে আমার প্রীয়তমার দেয়া উপহার আবার ফিরে পেতে পারি। টাকার বিষয়ে বলতে ছিলাম যদি কেউ আমাকে দেখতে আসে তাহলে তাকে দিয়ে দিয়েন। তখন ঐ ভদ্রলোক বলল আপনি পিসিতে এই টাকা ব্যবহার করতে পারবেন। আসলে পিসি কি এবং ভেতরে কি হয় তাও আমার জানা ছিলনা। ঐ ভদ্রলোকের পরামর্শে আমি টাকা পিসিতে দিতে বললাম। তিনি আমাকে বলল আমাকে কত দিবেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ঐ ভদ্যলোকের মুখের দিকে। শেষতক আর তাকাতে না পেরে বললাম আপনি দিয়ে দিন। আমি অস্পষ্ট চোখে দেখলাম পিসিতে ৩০০০ টাকা জমা হলো এবং ৫০০ টাকা ওনার পকেটে চলে গেল। সবই যেন অসহায়ত্বের মধ্যে এবং জলন্ত ধোকা মাত্র। ডাক এল সামনে যাওয়ার আর ঐ ডাকে সাড়া দেয়ার আগে পরিচয় হল জনাব মনিরো নামের এক পুলিশ কনষ্টেবল এর সঙ্গে। সে এবং আমি আমার পরিচয় দিয়ে কথা বললে সুবেদার সাহেব বরাবর (হাবিব সাহেব) একটি চিঠি দেয়া হয় যাতে আমাদের একটু ভাল ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেই চিঠির বাহক মুহুর্ত্বই হারিয়ে যায়। তখন আমাদেরকে ডেকে নেয়া হয় গরু, ভেড়া, মহিষ অথবা হাস মুড়গীর পালের মত। সামনে নিয়ে অনেক ভয়ভীতি দেখিয়ে চেক শুরু হয়। লোকদের দেখে মনে হয় ওরা অন্ধকার জগতের কোন হিং¯্র প্রাণী; যারা কিনা মানুষরূপী কাউকে দেখতে ও শয্য করতে পারে না। ভুলক্রমে কোন মানুষের প্রবেশ ঘটলে কি করতে কি করবে তা ঐ মুহুর্ত্বে ভেবে উঠতে পারে না। ঐ হম্বি তম্বি আচরণে স্বীকার হয়ে প্রায় দিশেহারা ও বিষন্ন মনে নিজেকে ধিক্কার দিলে শুরু করলাম।
শরীরের সকল অংশ স্পর্শ করে জীব জন্তুর মত আচরন করে বিভিন্ন প্রশ্ন করে আরেকটি লাইন দাঁড় করায়। তারপর এক এক করে গার ধাককা দিয়ে এনে এনে ভিতরে প্রবেশ করানো হয়। এখানে শুরু হয় আরেক প্রক্রিয়। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় মাঠে এবং আবারো লাইনে দ্বাড় করানো হয়। তারপর গালি দিয়ে বসতে বলা হয়। অনভিজ্ঞতার জন্য বুঝতে সময় লাগছে। তখন আবার দাড়াতে বলে এবং সমনে লাইন ধরে হাটতে বলে। হেটে গিয়ে কর্নফুলি দালানের সামনে আবার দাড় করানো হয়। আবার রাগ এবং গালি দিয়ে বসানো হয়।
তারপর ওনি (কারারক্ষি/ মিয়াসাহেব) গরু ছাগলের মত হাক ডাক দিয়ে আমাকে আরো ৩৫০ জন লোকের সঙ্গে আমদনিতে প্রবেশ করানো হয়। একটি রুম যেখানে ৫০জন লোক ধারন ক্ষমতা আর সেখানে ৩৫০ জন লোক প্রবেশ করালো। তিল ধরণের কোন জায়গা নেই। আমদানিতে গিয়ে অবস্থা দেখে আরো ভেঙ্গে পড়ি। ওখানে কারারক্ষি, সামান্য অথবা অসামান্য সাজাপ্রাপ্ত আসামীসহ সকলের সন্ত্রাসী আচরণে আমাকে মর্মাহত করে। মনিরু এবং আমি এক কোনে কোন রকম দাঁড়ালাম। কিছুক্ষন পড়ে একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামী যার কামপাস রয়েছে তিনি এসে আমাকে এবং মনিরুকে বের করে দিয়ে আসেন সুবেদার সাহেবের কাছে। সুবেদার সাহেব (হাবিব) সম্মানের সহিত আমাদের পরিচয় জানতে চান এবং জেল সর্ম্পকে বিস্তারিত বলেন। তারপর তিনি আমাদেরকে ফারুক নামে এক ভদ্রলোকের কাছে তুলে দেয়। বলে দেন যাতে ভাল ব্যবস্থা করেন। আমাদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। তারপর ঐ ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে পারি তিনি চিফ বাইটার ফারুক সাহেব। ফারুক সাহেব আমাকে অবয় দিয়ে দীর্ঘ বয়ান দেন এবং তিনি বলেন জেলে সবচেয়ে ভাল জায়গা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জীয়া যেভাবে থাকেন ঠিক সেই ভাবেই আমি আপনাকে রাখব। আমি বেশ আশ্বস্ত হয় এবং হতাশার মাঝেও একটি প্রশান্তির আশা পায়। মোটামোটি তার কথায় আস্থা পেয়ে একটু নিশ্চিত হয়।
পরে তিনি আলতাফ নামে এক ভদ্রলোকের হাতে আমাদেরকে তুলে দেন। আমি ঐ আলতাফ সাহেবের সঙ্গে আবার আমদানীতে গিয়ে ঢুকি। কিন্তু আমদানীতেতো পাকা ময়লা স্যাত স্যাতে অবস্থা; তা দেখে আবার একটু ভীত হয়। পরে আলতাফ সাহেব তার নিজের বিছানায় বসতে বলে। বিছানায় ছিল দুটি কম্বলের উপর একটি চাদর বিছানো। চাদরের নিচে একটি কম্বল দিয়ে মোড়ানো রোল যা বালিশ হিসেবে ব্যবাহার করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.