চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ না ফেরার দেশে চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে পাম অ্যাভিনিউয়ে নিজ বাড়িতে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। রেখে গেলেন স্ত্রী ও এক সন্তানকে। দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে প্রথমে কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন। এরপর ১৯৮৭ সালে কলকাতার যাদবপুর কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়ান তিনি। টানা ২০১১ সাল পর্যন্ত এই কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন তিনি।

১৯৪৪ সালের ১ মার্চ কলকাতায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার চাচা। আজীবন বামপন্থি ছিলেন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাতেও সমান আগ্রহ ছিল তার। শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে স্কুল জীবন শেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর সরকারি স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন।

১৯৬৬ সালে সিপিএমের প্রাথমিক সদস্যপদ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আর ১৯৭২ সালে সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে বিধানসভা ভোটে প্রথমবার লড়েন। ২০১১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সে জয়যাত্রা অব্যাহত থেকেছে। পশ্চিমবঙ্গ মন্ত্রীসভার বিভিন্ন দফতরও সামলেছেন তিনি। তথ্য সংস্কৃতি দফতর থেকে পর্যটন, নগর উন্নয়ন কখনও পূর্ণ মন্ত্রী, কখনও বা সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৯৬ সালের পর স্বরাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ১৯৯৯ সালে ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০০০ সালে তাকে স্থলাভিষিক্ত করেন বুদ্ধবাবু। পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বাম রাজত্বের শেষের ১০ বছরের মুখ্যমন্ত্রী তিনিই।

পরনে সাদা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি, বাঁ-দিকে পাট করে আঁচড়ানো চুল, শব্দচয়নে সদা সতর্কতা, গলার স্বরের গাম্ভীর্য, স্পষ্ট উচ্চারণে বাংলায় কথা বলা ১০ বছরেই তাকে করে তুলেছিল ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ব্র্যান্ড হয়েই থেকে গেলেন। বিতর্ক এসেছে, যেমনটা আসে রাজনীতির অনুসঙ্গে। তবে সেসব ঠেলে আজীবন ‘বুদ্ধবাবু’ হয়েই ছিলেন তিনি। কোনও বিরোধী রাজনীতিক তাকে ভাষার বাণে বিঁধতে গেলেও কখনও ‘বাবু’ ছাড়া সম্বোধন করেনি। এটাই বোধহয় ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’র ক্যারিশমা।

দক্ষিণ কলকাতায় পাম অ্যাভিনিউয়ের দু’কামরার ফ্ল্যাটে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অনাড়ম্ব জীবন কাটিয়েছেন তিনি। গত কয়েক বছরে অসুস্থ হয়ে একাধিকবার উডল্যান্ডস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বারবার সেই লড়াই জিতে ফিরেও এসেছেন। কখনওই হাসপাতালে যেতে চাইতেন না তিনি। পাম অ্যাভিনিউয়ের ঘরটাই ছিল তার সবটা। গত বৃহস্পতিবার সেই ঘরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। শেষ হল বাম রাজনীতির এক জামানার।

গত বৃহস্পতিবার সকালে বুদ্ধদেবের মৃত্যুর খবর জানান তার ছেলে সুচেতন ভট্টাচার্য। সকালে প্রাতঃরাশ করার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে  পড়েন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। খবর পাওয়া মাত্রই রাজনৈতিক নেতাবৃন্দ সেখানে ভীড় জমান।

এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই সিপিএমের কলকাতার সদর দফতর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মুজফফর আহমেদ ভবনে তৎপরতা তুঙ্গে উঠেছে। ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২৯ জুলাই অসুস্থ হয়ে পড়ায় দক্ষিণ কলকাতার আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে কদিন ভেন্টিলেশন (ইনভেনসিভ) সাপোর্টে ছিলেন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি। সঙ্গে ফুসফুস এবং শ্বাসনালিতে সংক্রমণও ধরা পড়েছিল। ১২ দিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাড়িতে ফিরে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ছিলেন তিনি।

দীর্ঘদিন ধরেই গুরুতর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন বুদ্ধবাবু। অসুস্থতার কারণে শেষ কয়েক বছর গৃহবন্দিই ছিলেন। আগেও কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার খোঁজ রাখতেন। বুদ্ধবাবুর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।

কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, দীর্ঘদিন আমরা একসঙ্গেই ছিলাম, একই কমপ্লেক্সে বাস করছি। তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী, তারও আগে যখন তথ্য সম্প্রচারমন্ত্রী ছিলেন, একসঙ্গে থেকেছি। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকলেও তার সঙ্গে কোনও দিন বিরোধ হয়নি। আমি বাংলা বনধের ডাক দিয়েছি, তিনি বনধের বিরোধিতায়। তবে রাজনীতি কখনও আমাদের ঘরে প্রবেশ করেনি।

তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, খারাপ লাগছে। রাজনীতিগতভাবে মতবিরোধ ছিল। সাংবাদিক হিসেবে বিরোধিতা করেছি, তৃণমূল নেতা হিসেবে বিরোধিতা করেছি। জমি ইস্যু নিয়ে বিরোধিতা করেছি। সাংবাদিক হিসেবে তার কাছ থেকে যে স্নেহ আমি পেয়েছি তার জন্য কৃতজ্ঞ। তিনি এমন একজন অমায়িক মানুষ, যিনি জানতেন আমি তার সমালোচক। এর পরও কখনও প্ল্লেনে যেতে যেতে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন, কখনও রাজস্থানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে ব্রেক ফাস্টে যাচ্ছেন, সেখানে সাংবাদিক হিসেবে আমাকে একা রেখেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাওয়া যাচ্ছে, এই প্রশ্রয় কখনও ভুলতে পারব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.