প্রশান্তি ডেক্স॥ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আবারও ‘ঝামেলা’ করলে আওয়ামী লীগের পরিণতি শুভ হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগারদের বলছি, এখনও সময় আছে আপনারা আর ঝামেলা কইরেন না। কারণ ঝামেলা করলে আপনারা টিকতে পারবেন না।’
গত বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) বিকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন।
নয়াপল্টনে বিএনপির উদ্যোগে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সদস্যদের বিচারের দাবিতে এই অবস্থান কর্মসূচি হয়। গত বৃহস্পতিবার কাকরাইল থেকে ফকিরেরপুল পর্যন্ত হাজার হাজার নেতা-কর্মীর উপস্থিতি অবস্থান কর্মসূচি সমাবেশে রূপ নেয়।
তিনি বলেন, ‘ইতিহাস বড় নির্মম, আল্লাহ তাআলার বিচার বড় নির্মম, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার (শেখ হাসিনার) মুখ দিয়ে প্রতিশোধ স্পষ্ট হয়েছিল। আল্লাহর কী হুকুম দেখেন, সেই তাকেই পালিয়ে যেতে হলো, আবার সেই জায়গায় তার গোড়া পোঁতা আছে।’
ঝামেলা না করার কথা জানিয়ে ফখরুল বলেন, ‘আমি সে জন্য আওয়ামী লীগারদের বলছি, এখনও সময় আছে আপনারা আর ঝামেলা কইরেন না। কারণ ঝামেলা করলে আপনারা টিকতে পারবেন না। আজ (১৫ আগস্ট) তো চেষ্টা করেছিলেন যে আপনারা যাবেন, ৩২ নম্বরে গিয়ে ফুল দেবেন। কারও তো আপত্তি ছিল না। কিন্তু ছাত্ররা তা হতে দেননি, হতে দেননি কেন? এই মানুষটাকে কেউ দেখতে চায় না। খুনি হাসিনার চেহারা কেউ আর দেখতে চায় না। এক হাসিনা সারা দেশে যত আওয়ামী লীগার ছিল, তারা খুদে হাসিনা তৈরি হয়েছে, সারা দেশে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে তারা।’
এ সময় ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে সুদৃঢ় করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসসচিব।
‘খুনি’ হাসিনার বিচার চাই : মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকের সমাবেশের ব্যানারে লেখা আছে, এই যে গণহত্যা, হাসিনা যে খুনি ও তার দোসরদের আমরা বিচার চাই। বিচার আল্লাহ তাআলা করছেন, আরও করবেন।’
নির্বাচিত সরকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বিচার চাই এই সরকারের কাছে, অন্তবর্তীকালীন সরকার, যাদের ওপর জনগণ আস্থা দিয়েছে, একটু স্বস্তি ফিরিয়ে এনে নির্বাচন দেবে, একটা সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন দেবে, সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার গঠন করবে। আমরা সেটাই চাই।’
নির্বাচনের যৌক্তিক সময়ও আমরা দেবো : মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা চাই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হোক। আমরা যৌক্তিক সময়ও দিতে চাই। একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই, গণতন্ত্রের কোনও বিকল্প নেই। এই গণতন্ত্রের জন্য আমরা লড়াই করছি। আমরা লড়াই করেছি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে, তারেক রহমানের নেতৃত্বে।’
ওদের টার্গেট অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করা : মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নতুন নতুন কৌশল ওরা আবিষ্কার করে। এখন নতুন একটা ধুয়া তুলেছে সেই ষড়যন্ত্রকারীরা। সেটা কী? মাইনরিটির ওপর অত্যাচার হচ্ছে। আমাদের ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) খুব সুন্দর করে বলেছেন যে বাংলাদেশে কোনও মাইনরিটি নাই, বাংলাদেশের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক: হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আমরা সবাই মিলে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি। সেই সূত্রে যারা আজ হিন্দু সম্প্রদায়কে আলাদা করে দেখতে চায়, আমরা তাদের সঙ্গে একমত নই। তারা সবাই এক নাগরিক।‘
‘কিন্তু তাদের (হিন্দু সম্প্রদায়) ক্ষেপিয়ে তাদের দিয়ে আবার ঢাল বানিয়ে আরেকটা কৌশল আবিষ্কার করে কীভাবে দেশে অস্থিতিশীল করা যায়, সেই চেষ্টা, সেই কৌশল, সেই ষড়যন্ত্র আওয়ামী লীগ করছে। তাদের মূল টার্গেট হচ্ছে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে আবার যদি ভারতের সাহায্য নিয়ে ঢুকে পড়া যায়। আপনারা দেখেছেন, ’৫২ সাল, ’৬৯, ’৭০, ’৯০ ও ’২৪ সালে দেশের মানুষ কীভাবে জেগে উঠতে পারে, ফুঁসে উঠতে পারে, গর্জে উঠতে পারে। কোনও শক্তি তাদের কাছে দাঁড়াতে পারে না, সেটাই প্রমাণিত হয়েছে এবারও।‘
এদিক-ওদিক না করে আত্মসমর্পণ করুন : মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি বলতে চাই, ভালোয় ভালোয় এসব ঝামেল ও ষড়যন্ত্র না করে আপনারা আত্মসমর্পণ করেন। যারা এখনও বাইরে আছেন, এদিক-ওদিক করছেন, তারা দেখেছেন গতকাল প্রবল প্রতাপশালী আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রবল প্রতাপশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান কী অবস্থায় তাদের নিয়ে গেছে কোর্টে।‘
‘জানেন তো ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। আমাদের নেতা-কর্মীদের কোর্টে এভাবে নেওয়া হয়েছিল এবং তারেক রহমান সাহেবকে ওইভাবে হেলমেট পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এদের বিচার করতে হবে। এদের বিচার করতে হবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিরোধী আইনে। অর্থাৎ যে অপরাধ করেছেন, যে ক্রাইম করেছেন, গণহত্যা করেছেন, অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন, তার বিচার আন্তর্জাতিক আইনে হতে হবে।’
অর্থ লুটেরাদের বিচার করতে হবে : মহাসচিব বলেন, ‘যারা অন্যায়-অত্যাচার করেছে, টাকা লুণ্ঠন ও পাচার করেছে, তাদের বিচার করতে হবে। বিএনপি জিয়াউর রহমানের দল। কেউ যেন অপবাদ দিতে না পারে, আমরা খারাপ কাজ করেছি সবাই একত্র থাকেন, ঐক্যবদ্ধ থাকবেন এবং এদের সব চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে আমরা বাংলাদেশকে যে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করেছি, তাকে সুসংহত করতে হবে।’
‘এই সরকারকে আমরা সাহায্য করবো। এটা ছাত্র-জনতার সরকার, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল। আমরা তাদের সহযোগিতা দেবো, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে, গণতান্ত্রিকভাবে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।’
চক্রান্তকারীদের সরকার থেকে বের করে দিতে হবে: ফখরুল বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হয়েছেন কিন্তু আমাদের তারেক রহমান সাহেব এখনও মুক্ত হননি। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা আছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে। কোনও মামলা থাকবে না।’
‘আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। আরও পদক্ষেপ তাদের নিতে হবে। যেসব চক্রান্তকারী সরকারের ভেতরে বসে আছে তাদের অবিলম্বে সরকার থেকে বের করে দিতে হবে, তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে। যারা চিহ্নিত সন্ত্রাসী, যারা কাজ করেছে শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আজ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন, তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমাদের দেশের মানুষের অনেক কামনা ছিল দেশনেত্রীকে মুক্ত অবস্থায় দেখতে চাওয়া। আমরা দেশনেত্রীকে মুক্ত অবস্থায় দেখেছি। আমাদের আর চাওয়ার কিছু নেই।’
আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা সবাই মনে রাইখেন। অনেকে দেখি এত আনন্দে আছেন, তাদের বলি, আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। এই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, এ দেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আমরা ১৭ বছর আন্দোলন করেছি। মনে রাখবেন, আমাদের আরও কিছুদিন পরিশ্রম করতে হবে, কষ্ট করতে হবে, দলকে সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল রাখবেন।‘
মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পরিচালনায় এই কর্মসূচিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, মহানগর দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনু, স্বেচ্ছাসেবক দলের এস এম জিলানি, যুবদলের নুরুল ইসলাম নয়ন, কৃষক দলের শহীদুল ইসলাম বাবুল, সাবেক ছাত্রদল নেতা হাবিবুর রশীদ হাবিব ফজলুর রহমান খোকন প্রমুখ বক্তব্য দেন।