প্রশান্তি ডেক্স॥ বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন করতে যাচ্ছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। এই শ্বেতপত্র প্রস্তুতের জন্য অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বুধবার (২১ আগস্ট) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এই তথ্য জানানো হয়।
‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ নামে প্রস্তাবিত কমিটি আগামী ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে একটি সুপারিশ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে।
শ্বেতপত্রটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হবে। পাঁচটি পয়েন্ট প্রকাশ করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম পয়েন্ট জানানো হয়, গত প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিগত সরকারের চরম অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অর্থ-পাচার এবং অপরিণামদর্শী প্রকল্প নেওয়ায় দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণ ইত্যাদি কার্যক্রমের কারণে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে। অর্থ বিভাগের সূত্রে পত্রিকান্তরে প্রকাশ যে, পতনকালে শেখ হাসিনা সরকার ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে গেছেন। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের যে স্থিতি ছিল, তা বাংলাদেশের তিনটি বাজেটের মোট অর্থ বরাদ্দের সমান। অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কর আদায়ের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা না করে, দেশি ও বিদেশি দুই ধরনের ঋণের প্রতি বিগত সরকার ঝুঁকেছিল। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির তুলনায় কর সংগ্রহকে ১৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গত ছয় সাত বছরে এ অনুপাত ১১ শতাংশ থেকে উল্টো ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার এটি একটি দিক মাত্র। সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি, অর্থ-পাচারের অবাধ সুযোগ, বাজার সিন্ডিকেট ইত্যাদির ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, যেটি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বলা যেতে পারে যে, বিগত সরকারের শেষ সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই মুখ থুবরে পড়ে।
দ্বিতীয় পয়েন্টে বলা হয়, বিগত সরকারের সার্বিক অব্যবস্থাপনার ফলে সৃষ্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির নজিরবিহীন নাজুক পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে সুসংহতকরণে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে; তার মধ্যে প্রধানতম হলো, অর্থনীতি আবার সচল করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো নিরসনে কাঠামোগত সংস্কার সাধন, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দূরীকরণ, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, কর ও শুল্ক নীতির সংস্কার, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ইত্যাদি।
জানানো হয়, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি সামগ্রিক চিত্র এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রারম্ভেই সরকারের হাতে থাকা প্রয়োজন।
তৃতীয় পয়েন্টে বলা হয়, এ লক্ষ্যে “প্রিপারেশন অব এ হোয়াইট পেপার অন দ্য স্টেট অফ দ্য ইকোনমি” শিরোনামে একটি ধারণাপত্র নথিতে সংরক্ষিত রয়েছে। ধারণাপত্রে বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার তথ্য-চিত্র সমৃদ্ধ একটি ‘শ্বেতপত্র’ (ডযরঃব চধঢ়বৎ) প্রস্তুতের ধারণা দেওয়া হয়েছে। ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ, এসডিজি বাস্তবায়ন এবং এলডিসি হতে উত্তরণে করণীয় বিষয়ে প্রতিফলন থাকবে। শ্বেতপত্রটি প্রণয়নের সময় বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও মতবিনিময় করা হবে মর্মে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে।
চার নম্বর পয়েন্টে বলা হয়, প্রস্তাবিত শ্বেতপত্রে প্রধানত বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোকপাত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে পাবলিক ফিন্যান্স ম্যানেজমেন্ট, ইনফ্লেশন অ্যান্ড ফুড ম্যানেজমেন্ট, এক্সটারনাল বাজেট, বিদ্যুৎ-জ্বালানির চাহিদা, সরবরাহ, দাম, বেসরকারি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
পাঁচ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়, প্রস্তাবিত শ্বেতপত্রটি প্রস্তুতের জন্য দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শক্রমে তিনি কমিটির প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যকে মনোনীত করতে পারেন। কমিটির রূপরেখার বিষয়ে জানানো হয় যে, কমিটির সদস্যরা অবৈতনিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, পরিকল্পনা কমিশন কমপ্লেক্সের যথোপযুক্ত কোনও ভবনকে কমিটির দফতর হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দিতে পারে, সরকারের সকল মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা দফতর বা সংস্থা প্রস্তাবিত কমিটির চাহিদানুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহসহ সকল ধরণের সহযোগিতা দেবে, ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ নামে প্রস্তাবিত কমিটি আগামী ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে সুপারিশগুলো প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবেন। শেষের এই প্রস্তাবটি প্রধান উপদেষ্টার সদয় বিবেচনা ও সানুগ্রহ অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলো।