প্রশান্তি ডেক্স॥ চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আনসার সদস্যদের আন্দোলনে দিনভর অবরুদ্ধ থাকার পর রবিবার (২৫ আগস্ট) দিবাগত রাত ১১টার দিকে সচিবালয় থেকে বেরিয়ে আসলেন অন্তরবর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের সংঘষের্র ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ অর্ধশতাধিক। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সচিবালয় এলাকায় বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরে রাতেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন এলাকায় গত সোমবার (২৬ আগস্ট) থেকে যে কোনও সভা, সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন পেশাজীবীদের দাবি-দাওয়ার মধ্যেই আন্দোলনে নামেন আনসার সদস্যরা। তাদের কয়েকটি দাবির মধ্যে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন আনসার সদস্যরা। একই দাবিতে রবিবার সকালেও প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হন তারা। এক পর্যায়ে তারা বেলা ১২টার দিকে সচিবালয়ের চারপাশে পাঁচটি ফটকে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপর থেকেই ভেতরে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাসহ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বেলা আড়াইটার দিকে বিক্ষোভকারী আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে বেরিয়ে আসেন অন্তরবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। আনসার সদস্যদের দাবি ‘যৌক্তিক’ উল্লেখ করে মেনে নেওয়ারও আশ্বাস দেন তারা।
জানা যায়, বিকালে আনসার সদস্যদের সাত সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ওই বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, আনসার থেকে রেস্ট প্রথা (প্রতি তিন বছর ছয় মাসের বাধ্যতামূলক বিরতি) বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে তাদের অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে একটি কমিটি করা হবে। এই কমিটি সব কিছু পর্যালোচনা করে আমাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবে। সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটি সিদ্ধান্ত নেবো।
সচিবালয়ের এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াসহ আরও কয়েকজন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিলের সিদ্ধান্ত হলেও তাতে আশ্বস্ত না হয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকেন আনসার সদস্যরা। এ অবস্থায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিকাল ৫টায় অফিস শেষ হলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখান থেকে বের হতে পারেননি। এমনকি এক পর্যায়ে সচিবালয়ের ক্যান্টিনে খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছিল বলে জানা গেছে।
আনসারদের বিক্ষোভে সচিবালয়ের আশপাশের সড়কে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এই অবস্থায় রাত পৌনে ৮টার দিকে সচিবালয়ে পাঁচ জন উপদেষ্টার সঙ্গে আবারও জরুরি বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। আনসার বাহিনীর ১০ জন প্রতিনিধিও সেখানে যোগ দেন।
এরই এক পর্যায়ে সচিবালয় থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দুই সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফেসবুকে পোস্ট করে আনসার সদস্যদের প্রতিরোধের ঘোষণা দেন। তারা ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান এবং আনসার সদস্যদের প্রতিরোধ করতে বলেন।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হলে উপস্থিত হন সেনা সদস্যরা : পরে সারজিস আলম গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, তাদের মধ্যস্ততায় আনসার সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দল ভেতরে গিয়ে আলোচনায় করে। তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়ার কথাও জানানো হয়। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। তবে বাইরে থাকা কিছু সদস্য তাদের বর্জন করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
দুই সমন্বয়কের ঘোষণার পর রাত সাড়ে ৯টার দিকে শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের দিকে গেলে সেখানে থাকা আনসার সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে অল্প কিছু শিক্ষার্থী সচিবালয় এলাকায় আসলে আনসার সদস্যরা তাদের ওপর হামলা চালান। এসময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় সচিবালয় ত্যাগ করেন আনসার সদস্যরা: এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কিছুটা পিছু হটে শিক্ষা চত্বরে অবস্থান নেন। পরে চারদিক থেকে আরও সহস্রাধিক শিক্ষার্থী এসে আনসার সদস্যদের ধাওয়া দেন। এ সময় তাদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি পথও খোলা রাখা হয়। ধাওয়া খেয়ে আনসারদের একটি অংশ জিপিও হয়ে, আরেকটি অংশ প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে চলে বেরিয়ে যান। অবশ্য তখনও কিছু সংখ্যক আনসার সদস্য সচিবালয়ের ২ নম্বর গেটের সামনে আটকা পড়েন। সেনাবাহিনীর সদস্য ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশই তাদের রক্ষার চেষ্টা করেন। জানা গেছে, তাদের কয়েকজনকে সচিবালয়ের ভেতরে নিয়ে পাহারা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। সাড়ে ১০টার দিকে গেট খুলে দিলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসেন অবরুদ্ধ উপদেষ্টা ও সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গেটের সামনে তাদের স্বাগত জানান শিক্ষার্থীরা। পরে পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণের নেয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ।