প্রশান্তি ডেক্স॥ বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ঘিরে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এই বনের সৌন্দর্য দেখতে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। তবে বন ঘিরে মানুষের যত আগ্রহ, কিছু অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতার কারণে সেটা মেটাতে পারছেন না পর্যটকরা। এগুলোর বিষয়ে উদ্যোগ নিলে পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন ভ্রমণ আরও আনন্দের হবে। এখানে পর্যটনশিল্পের বিকাশ হলে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি ও এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর লাখো পর্যটক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন দেখতে যান। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এ সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় দায়িত্বশীলদের সঠিক কর্মপরিকল্পনা, বন বিভাগ ও পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে বারবার হোঁচট খাচ্ছে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন। এতে অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নও ব্যাহত হয়।
পর্যটকরা বলছেন, পর্যটনের ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনা থাকলেও দীর্ঘদিনেও পর্যটকদের জন্য বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা। এ ছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা, রাতে অবস্থান, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও নিশ্চিত হয়নি। সুন্দরবনের সড়কপথে চলাচলের তেমন কোনও ভালো ব্যবস্থা নেই। বনের ভেতর ঘুরে দেখার জন্য ওয়াকওয়ের অবস্থা তেমন ভালো না। এসব কারণেই ঠিক ওভাবে পর্যটক টানতে পারছে না সুন্দরবন।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু সুন্দরবনের প্রতিবেশ, পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই এখানে ইকোট্যুরিজমের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন। যা তৈরিতে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পর্যটনশিল্পের বিকাশে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জীববৈচিত্র্যের প্রাণ-প্রাচুয্যের কারণে সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র। এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম। এ ছাড়া বনে আছে নানা ধরনের পাখি, চিত্রাল হরিণ, কুমির, ডলফিনসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী। তাই সুন্দরবন ঘিরে গড়ে তুলতে হবে ইকোট্যুরিজম। তবেই এটি বিনোদনের পাশাপাশি গবেষণার স্থান হয়ে উঠবে। বাড়বে প্রসার।
পরিবেশবিদরা বলছেন, সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনকে যদি সুন্দর করে নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিচালনা করা যায় তাহলে এটি বিরাট সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হবে। এ ছাড়া সুন্দরবনে পর্যটককেন্দ্রিক যেসব নৌযান আছে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করা গেলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে না। তখন পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন ভ্রমণ আরও আনন্দের হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক মো. নুর আলম শেখ বলেন, ‘সুন্দরবনের প্রাকৃতিক যে বৈশিষ্ট্য এবং জীববৈচিত্র্য রয়েছে সেগুলোকে রক্ষা করেই পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। বনের আশপাশে যেসব গ্রাম আছে সেগুলোকে ইকোট্যুরিজম সেন্টারে পরিণত করতে হবে। যেসব পর্যটক এখানে প্রবেশ করেন তারা যাতে বন্যপ্রাণীর ক্ষতি না করেন, প্লাস্টিক দূষণ না করেন, পরিবেশ সম্পর্কে সতেচন থাকেন, সে ব্যাপারে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।’
পর্যটনশিল্পের বিকাশ হলে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি ও এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা। সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনকেন্দ্রিক পরিবেশবান্ধব পর্যটনশিল্পের বিপুল সম্ভাবনা আছে। এতে একদিকে দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধ হবে অন্যদিকে শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। তবে বনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরবন ভ্রমণের নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে পর্যটকদের সুন্দরবন ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কারও কোনও ক্ষতি না হয়।’
বন বিভাগ জানিয়েছে, সুন্দরবনের পর্যটন এলাকাগুলোতে পর্যটকবান্ধব অবকাঠামো না থাকা ও অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ব্যাহত হচ্ছে ইকোট্যুরিজম। ২০১৪ সালে ভ্রমণ নীতিমালা প্রণীত হয়েছিল। যার আলোকে নতুন পর্যটনকেন্দ্র বাড়ানোর কাজ চলছে। তবে এখনও কাজ শেষ হয়নি।
এ বিষয়ে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ‘২০১৪ সালের ভ্রমণ নীতিমালা অনুযায়ী সুন্দরবনে বেশ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে ১১টি পর্যটনকেন্দ্র আছে। পর্যটকরা সেখানে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছেন।’
তিনি বলেন, ‘পর্যটকরা সুন্দরবনে যতই আসুক না কেন তাদের আমাদের ধরে রাখার মতো সক্ষমতা আছে। পরিবেশের ক্ষতি হবে না। এ ব্যাপারে বনরক্ষীদের প্রশিক্ষন দেওয়া আছে। সে অনুযায়ী পর্যটকদের সেবা দেওয়া হয়।’
সুন্দরবন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের গাইড শাকিল আহমেদ বলেন, কিছু সমস্যার কারণে বিদেশিরা একটু আকর্ষণ কম দেখাচ্ছে। আশা করি, এই খাত থেকে আরও আয় করা সম্ভব। যদি সরকার একটু নজর দেয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বও ছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস। প্রতি বছরের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও যথাযথভাবে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা নির্ধারিত প্রতিপাদ্যের সঙ্গে মিল রেখে দেশে প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘পর্যটন শান্তির সোপান’। পর্যটনশিল্পের বিকাশে পর্যায়ক্রমে ‘পর্যটন সপ্তাহ’ ও ‘পর্যটন মাস’ উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনসচিব নাসরীন জাহান।