প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ গাজায় চলমান ইসরায়েলি যুদ্ধের এক বছর পর, আরব বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি জনগণের সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই সমর্থনের ঢেউ সত্ত্বেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে আঞ্চলিক সরকারগুলো এখনও কার্যকরভাবে এগিয়ে আসেনি। আরব দেশগুলো এই পরিস্থিতিতে সমালোচনামূলক অবস্থান গ্রহণ করছে। তবে সেই সঙ্গে তারা কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ককে বজায় রাখার চেষ্টাও করছে। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম আল মনিটর এ খবর জানিয়েছে।
এই সংঘাতের পটভূমিতে ইসরায়েলের হামলা লেবাননে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের ওপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আরও উত্তেজনা বাড়িয়েছে। তবে আরব সরকারগুলো কৌশলে এগিয়ে চলছে। তারা ইসরায়েলের আক্রমণ নিন্দা করছে। কিন্তু যেসব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তারা এখনও বড় কোনও নীতিগত পরিবর্তন আনতে পারেনি।
জনগণের সমর্থনের অবমূল্যায়ন: বাহরাইনে এক বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ২৭ বছর বয়সী আহমেদ বলেন, আমাদের সরকার, অন্যান্য আরব সরকারগুলোর মতো জনগণের দাবি উপেক্ষা করেছে। ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে না।
বাহরাইন, মরক্কো, সুদান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম চুক্তির অধীনে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর মাধ্যমে আরব দেশ ৪টি কূটনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পেতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে, ১৯৭৯ ও ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মিসর ও জর্ডান। এখনও সেই চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা করেনি। যদিও তারা গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলেছে। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইমান সাফাদি বলেছেন, শান্তিচুক্তিতে ‘ধুলো জমে গেছে’। তবে চুক্তি বাতিল করা জর্ডান বা ফিলিস্তিনিদের জন্য সহায়ক হবে কিনা তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।
শুধু সৌদি আরব প্রকাশ্যে অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তারা ঘোষণা করেছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আলোচনা স্থগিত রাখবে।
বিক্ষোভের জটিলতা : ইসরায়েলের গাজা আক্রমণ আরব দেশগুলোতে বিরল বিক্ষোভের সূত্রপাত করেছে। এসব অঞ্চলে সাধারণত কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো প্রতিবাদ দমন করে। আম্মানের একটি বিক্ষোভে একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ হলো বিশ্বাসঘাতকতা’। বাহরাইন ও মরক্কোর ে¯্লাগানগুলোতেও একই সুরের প্রতিধ্বনি রয়েছে।
মরক্কোর ন্যাশনাল অ্যাকশন গ্রুপ ফর প্যালেস্টাইনের নেতা রাশিদ ফেললুলি বলেছেন, গত বছর ৫ হাজার অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ফিলিস্তিনপন্থি সংহতির উত্থান দেখে তিনি আশাবাদী। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা আরব সরকারগুলো নিজেদের সুরক্ষা ও কূটনৈতিক সুবিধার কারণে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করার কোনও ইঙ্গিত দিচ্ছে না।
জনগণের চাপ ও ভবিষ্যৎ প্রভাব : বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণের চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে তা অনেক সরকারের জন্য বিপজ্জনক উদাহরণ তৈরি করতে পারে। আরব বসন্তের আন্দোলনগুলো এখনও এই সরকারগুলোর জন্য এক ধরনের ভীতি হিসেবে কাজ করে।
গাজায় চলমান এই সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। ওই দিন হামাসের নজিরবিহীন আক্রমণের মাধ্যমে ১ হাজার ২০৫ জন ইসরায়েলি নিহত হন। নিহতদের বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক। পাল্টা আক্রমণে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গাজায় কমপক্ষে ৪১ হাজার ৬৮৯ জন নিহত হয়েছেন। হামাস পরিচালিত অঞ্চলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। জাতিসংঘ এই পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করেছে।
নতুন প্রজন্মের উদীয়মান রাজনীতি : আরব নেতারা জনসাধারণের দাবির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে কৌশলে কাজ করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবাদ দমন করলে জনগণের মধ্যে অব্যবস্থাপনা, বেকারত্ব বা জীবনযাত্রার ব্যয়ের মতো সমস্যা নিয়ে অস্থিরতা বাড়তে পারে। অন্যদিকে, প্রতিবাদ করার সুযোগ দিলে তা নিরাপদে হতাশা প্রকাশের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিসরে প্রতিবাদের ঝুঁকি খুব বেশি। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর থেকে কোনও বিক্ষোভের অনুমতি দেওয়া হয়নি। ওই সময় রাষ্ট্র-অনুমোদিত একটি প্রতিবাদ তাহরির স্কোয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। এই স্কয়ার ছিল ২০১১ সালের বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা : দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও লড়াইয়ের সমর্থক মিসরীয়রা এখন ইসরায়েল বয়কট প্রচারণার দিকে ঝুঁকেছে। বিশেষ করে ইসরায়েলপন্থি বলে মনে করা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। একটি মোবাইল অ্যাপসের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘ফিলিস্তিন শুধু ফিলিস্তিনিদের লড়াই নয়’। এই অ্যাপসটি বয়কটের তালিকায় থাকা ইসরায়েলি পণ্যের বারকোড স্ক্যান করতে ব্যবহারকারীদের সহায়তা করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রচারণাগুলোর তাৎক্ষণিক প্রভাব সীমিত হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, আরব বসন্তের পরের প্রজন্ম, যারা কখনও মুক্তভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দেখেনি, তারা ফিলিস্তিনি অধিকারের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে জাগ্রত হচ্ছে।