প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ঝটিকা সফরে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাজধানী কিয়েভে গিয়েছিলেন, তখন হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি কিছু একটা অনুভব করছি এর আগে কখনও এমনটা অনুভূত হয়নি।’ এর কিছুক্ষণ পর তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘বিশ্বের একটি বাতিঘর আমেরিকা।’
আগামী সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই স্বঘোষিত বাতিঘরের দায়িত্ব কে নিতে যাচ্ছেন তা দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ববাসী। কমলা হ্যারিস বিজয়ী হয়ে কি বাইডেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন, যেমনটা তিনি বলেছিলেন‘ এই অস্থির সময়ে এটি স্পষ্ট, আমেরিকা পিছু হটতে পারে না’ নাকি ‘বিশ্ববাদ নয়, আমেরিকাবাদ’ এই মন্ত্র নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ের মশাল ধরবেন?
গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) বিবিসির একটি বিশ্লেষণে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানে আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করছি যেখানে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রশ্নবিদ্ধ। গাজা, ইউক্রেন এবং অন্যান্য অঞ্চলে বিধ্বংসী যুদ্ধ ওয়াশিংটনের ভূমিকার মূল্য নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন সামনে এনেছে। তবে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এবং অনেক জোটে দেশটির প্রধান ভূমিকার কারণে আমেরিকা এখনও গুরুত্বপূর্ণ।
সামরিক শক্তি : যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর অন্য ৩১ সদস্যের সামরিক বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ। ন্যাটোর বাইরে চীন, রাশিয়াসহ সামরিক খাতে বেশি ব্যয় করা পরবর্তী ১০ দেশের মোট ব্যয়ের চেয়েও বেশি ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প দম্ভ করে বলেছেন, অন্যান্য ন্যাটো রাষ্ট্রকেও তাদের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে বাধ্য করবেন তিনি, যা তাদের জিডিপির ২ শতাংশ। তবে ২০২৪ সালে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র ২৩ সদস্য রাষ্ট্র।
ন্যাটোর সাবেক ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল রোজ গোটেমোলার মনে করেন, ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে কমলা হ্যারিস জিতলে ন্যাটো নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনের হাতে থাকবে। তিনি বলেন, ইউক্রেনে বিজয় অর্জনের জন্য হ্যারিস ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত থাকবেন। তাই বলে হ্যারিস যে ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর জন্য চাপ দেওয়া থেকে পিছপা হবেন না, এ বিষয়েও সতর্ক করেন তিনি।
তবে বিরোধী হিসেবে ডেমোক্র্যাট যে কংগ্রেসে উপস্থিত থাকবেন এ বিষয়টিও মনে করিয়ে দিয়েছেন ন্যাটোর সাবেক ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি বলেন, এটি খুবই স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা যার হাতেই থাকুক না কেন ইউক্রেনকে অবশ্যই এই যুদ্ধ শেষ করার বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। কেননা, বড় বড় সহায়তা প্যাকেজ পাস করার বিষয়ে মার্কিন আইনপ্রণেতাদের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে।
তবে রোজ বলেন, যাই ঘটুক, ‘আমি মনে করি না ন্যাটো ভেঙ্গেচুরে যাবে।’ ইউরোপকে অবশ্যই ‘নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে হবে।’
শান্তি স্থাপনকারী? : পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এমন একটি বিশ্বে কাজ করতে হবে, যেখানে শীতল যুদ্ধের পর থেকে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘাতের সবচেয়ে বড় বড় ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও কমফোর্ট ইরো বিবিসিকে বলেন, ‘শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক শক্তি। তিনি অবশ্য সতর্কও করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের এখন ‘দ্বন্ধ সমাধানে সহায়তা করার শক্তি হ্রাস পেয়েছে।’
কমফোর্ট ইরো আরও বলেন, যুদ্ধ শেষ করা কঠিন হয়ে উঠছে। তার মতে, ‘মারাত্মক সংঘাত আরও জটিল হয়ে পড়ছে, বড় বড় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং মধ্যম শক্তিগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
তিনি আরও সহজ করে বলেন, ইউক্রেনের মতো যুদ্ধগুলো একাধিক শক্তিকে টেনে আনে এবং সুদানের মতো সংঘর্ষগুলো একে-অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্ধী স্বার্থের সঙ্গে আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের ক্ষমতার খেলা অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়। ইরো বলেন, কেউ কেউ তো শান্তির চেয়ে যুদ্ধেই বেশি বিনিয়োগ করে।
আমেরিকার নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে বলেও সতর্ক করেছেন ইরো। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বনেতারা লক্ষ্য করেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার কর্মকান্ডের জন্য একটি এবং গাজায় ইসরায়েলের কর্মকান্ডের জন্য অন্য একটি মানদন্ড প্রযোজ্য। সুদানের যুদ্ধ ভয়ানক নৃশংসতা দেখালেও তা দ্বিতীয় স্তরের সমস্যা হিসেবেই বিবেচিত হয়। তার মতে, হ্যারিসের জয় ‘বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে ধারাবাহিকতার প্রতিনিধিত্ব করে।’
অন্যদিকে, ট্রাম্প বিজয়ী হলে গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ইস্যুতে তিনি ইসরায়েলের হাত আরও মুক্ত করে দিতে পারেন। কেননা, ট্রাম্প একদিকে, ‘শান্তিতে ফিরে আসার এবং মানুষ হত্যা বন্ধ করার’ সময় এসেছে বলে ঘোষণা দেন। অন্যদিকে, তিনিই আবার ইসরায়েলি নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘আপনার যা করা দরকার তাই করুন’ বলে উস্কানি দেন।
রিপাবলিকান এই প্রার্থী নিজেকে শান্তিপ্রিয় বলে দম্ভ করে থাকেন। গত রবিরার রাতে সৌদি আরবের আল আরাবিয়া টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনব এবং তা খুব শিগগিরই।’
তবে ইউক্রেনের বিষয়ে ট্রাম্প কখনই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো শক্তিশালীদের প্রশংসা করতে কারচুপি করেন না। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চান। সাম্প্রতিক একটি নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি যাব। আমাদের যেতেই হবে।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মস্কোর সঙ্গে ইউক্রেনকে চুক্তিতে বাধ্য করতে পারেন ট্রাম্প। তবে বিপরীত কথা বলেছেন হ্যারিস। তিনি বলেন, ‘আমি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে গর্বিত। আমি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াবো এবং এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে বিজয়ী করতে কাজ করব।’
এদিকে, ইরোর উদ্বেগ, নির্বাচনে বিজয়ী যে-ই হোক না কেন, বিশ্বের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্য : তবে চীনের বিরুদ্ধে রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্র্যাট সব দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অবস্থান এক। উভয় দলই বেইজিংকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ মনে করেন।
কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা চলছে। এ অবস্থায় চীন থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। চীন মনে করছে, ট্রাম্প কিংবা হ্যারিস উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কঠিন।