বর্তমানের বন্ধ সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে অনিশ্চয়তায় সোয়াকোটি উপকারভোগী

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি (প্রতীকী ছবি)

প্রশান্তি ডেক্স ॥ পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার সোহাগদল গ্রামের বাসিন্দা বেলা বেগম। স্বামী পরিত্যক্তা ৭২ বছর বয়স্ক এই নারী গত চার মাস ধরে বয়স্ক ভাতা পান না। কেন পান না তার কারণ জানেন না তিনি। কারণ জানতে তিনি বারবার খোঁজ নিতে আসেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের দফতরে।

একই জেলার নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামের প্রতিবন্ধী কিশোর মেহেদী হাসান। বয়স ১৯ বছর। তিনিও চার মাস ধরে পাচ্ছেন না প্রতিবন্ধী ভাতা। কেন চার মাস ধরে ভাতা পাচ্ছেন না তার কারণ তিনিও জানেন না বলে বারবার খোঁজ নেওয়ার জন্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের দফতরে আসেন।

জানা গেছে, এভাবেই শুধু বেলা বেগম বা মেহেদি হাসানই নয়, প্রতিদিনই শত শত মানুষ ভাতার খবর নিতে আসেন নিজ নিজ স্থানীয় চেয়ারম্যানের দফতরে। কোনও সদুত্তর না পেয়ে তারা বাড়ি ফেরেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। দীর্ঘ চার মাস ভাতার টাকা না পেয়ে তারা কষ্টে আছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। 

খোদ রাজধানীতেও চলছে একই অবস্থা। রাজধানীর ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দফতরে ভিড় করছেন ভাতাভোগীরা। সম্প্রতি ওয়ার্ড কাউন্সিলের দফতর থেকে সুবিধাভোগীদের কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কাউন্সিলরের দফতরে হাজির হতে নোটিশ ও মাইকিং করা হয়েছে। সুবিধাভোগীদের বেশিভাগই নির্দিষ্ট তারিখের নির্দিষ্ট সময়ে হাজিরও হয়েছেন। কিন্তু কী কারণে হাজির হতে নোটিশ করা হয়েছে তা তারা জানেন না। তারা ভাতা না পেয়ে ফিরে গেছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। 

এদিকে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নতুন তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভাতা দেওয়া হয়নি। আপাতত বন্ধ রয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সকল প্রকার ভাতা। কবে নাগাদ তা সুবিধাভোগীদের দেওয়া হবে তা জানাতে পারেনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র। অভিযোগ রয়েছে, এ কার্যক্রমের আওতায় অনেক সচ্ছল ব্যক্তি ভাতা নিচ্ছেন। সচ্ছল ব্যক্তিদের ভাতাভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে। গত ৮ আগস্ট অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় এ রকম অনেক সচ্ছল ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে প্রকৃত উপকারভোগীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে যারা এখন ভাতাভোগীর তালিকায় আছেন, তারা আসলেই ভাতা পাওয়ার যোগ্য কিনা, তা দেখতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে। সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি বাজেটে ভাতাভোগীদের জন্য ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত প্রতি অর্থবছরের প্রথম তিনমাসের ভাতা একসঙ্গে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেওয়া হয়। সারা দেশের ১ কোটি ২১ লাখ উপকারভোগী এই ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত কেউ ভাতা পাননি।

জানা গেছে, ভাতাভোগীর তালিকা নির্ধারণে যে নীতিমালা তাতে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। কমিটিতে জনপ্রতিনিধিকে সভাপতি হিসেবে রাখা হয়েছে। চলতি বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পরিবর্তনের পরে অনেক স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি অনুপস্থিত রয়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন, অনেকেই রাজনৈতিক কারণে মামলায় পড়েছেন, আবার কেউবা একই কারণে পলাতক রয়েছেন। ফলে জটিলতা তৈরি হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কার্যক্রমের আওতায় ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে। কবে নাগাদ এই জটিলতা কাটবে তা জানেন না কেউই।

ইউনিয়ন পর্যায়ে এ কমিটি না থাকলে বিকল্প কী হতে পারে, তা নীতিমালায় বলা আছে। সেখানে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে সভাপতি করা আছে। কিন্তু এ তথ্য অনেকে জানেন না। ফলে উপকারভোগীর তালিকা করতে দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে আট জেলায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) নেই। ওই জেলাগুলোতেও ভাতাভোগীদের তালিকা তৈরিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে আটকে আছে পুরো কার্যক্রম।

এদিকে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এবার সময়মতো ভাতা না পাওয়ার কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার নেই। অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উপকারভোগীদের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সমাজসেবা অধিদফতর বলছে, ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়। উপকারভোগীদের তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম প্রান্তিকের ভাতা ছাড় করা হবে। চলতি নভেম্বরের মধ্যে ভাতা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সমাজসেবা অধিদফতরের সূত্র।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার সোহাগদল গ্রামের বাসিন্দা বেলা বেগম জানিয়েছেন, এক নাগারে চার মাস ধরে ভাতা পাচ্ছি না। এতে কষ্ট তো হচ্ছে। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি জানিয়েছেন, এই ভাতা পাওয়ার পর থেকে নিজের অনেক খরচ এটা দিয়ে মিটাতাম। এখন পারছি না। এখন অন্যের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। একই ধরণের মন্তব্য করেছেন নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামের প্রতিবন্ধী কিশোর মেহেদী হাসান।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার ১নং বালুভরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আয়েনউদ্দিন মিয়া জানিয়েছেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কার্যক্রমের আওতায় যারা ভাতা পেতেন তারা প্রতিনিয়তই খোজ-খবর নিতে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে আসেন। কিন্তু আমরা তাদের কোনও উত্তর দিতে পারছি না।

একইভাবে পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার সোহাগদল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ জানিয়েছেন, শুনেছি ভাতা পাচ্ছেন না উপকারভোগীরা। কেউ কেউ পরিষদে এসে খোঁজ নিচ্ছেন কবে নাগাদ তারা ভাতা পাবেন। আমাদের কাছে এর কোনও সমাধান তো নাই।

ঠিক একই ভাবে একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সকল ইনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের জিজ্ঞাসাবেদ একই কথা জানিয়েছেন, শুনেছি ভাতা পাচ্ছেন না উপকারভোগীরা। কেউ কেউ পরিষদে এসে খোঁজ নিচ্ছেন কবে নাগাদ তারা ভাতা পাবেন। আমাদের কাছে এর কোনও সমাধান তো নাই।

জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ জানিয়েছেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কার্যক্রমের আওতায় কোনও ভাতা বন্ধ করা হয়নি। ভাতাভোগীদের কার্ড যাচাই-বাছাই চলছে, এটি অবিলম্বেই শেষ হবে। এবং ভাতা প্রদান শুরু হবে।

সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিরা না থাকায় তালিকা চূড়ান্ত করতে সময় লাগছে। তাই এবার প্রথম প্রান্তিকের ভাতা দিতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে ভাতা বন্ধ হচ্ছে বলে যা শোনা যাচ্ছে, এটা পুরোপুরি গুজব।

সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বয়স্কভাতা পাচ্ছেন ৬০ লাখ ব্যক্তি। মাথাপিছু মাসিক ভাতা পান ৬০০ টাকা। বিধবা ভাতা পান প্রায় ২৮ লাখ।  মাথাপিছু ভাতা ৫৫০ টাকা। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৩২ লাখ।  মাথাপিছু ভাতা ৮৫০ টাকা। হিজড়া জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা পান ১৩ লাখ।  মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৬০০ টাকা। বেদে জনগোষ্ঠীর ৬ হাজার জন ভাতা পান। মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা পান ৬০ হাজার। মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা। সাধারণত তিন মাস অন্তর উপকারভোগীদের ভাতার টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.