সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ‘শূন্যতা’

প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর কোনোটিতে আছে জনবল সমস্যা। কোথাও যন্ত্রপাতির অভাব। এখন যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তা সংকট। সম্প্রতি দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা, সরকারের পটপরিবর্তনের পর শূন্যতা তৈরি হয়েছে অনেক হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে। সব মিলিয়ে নানা রকম ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলো। গত ৩০ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সঙ্গে বৈঠকে এসব তথ্য জানান সরকারি হাসপাতালের পরিচালকরা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সব সরকারি হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে উপদেষ্টার এই বৈঠক হয়। সারা দেশের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম নিয়ে ওই সভার আয়োজন করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

ব্যবস্থাপনা কমিটিতে শূন্যতা : মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। হাসপাতালের সেবা সংক্রান্ত নানা সিদ্ধান্ত ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়ে থাকে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কমিটির সভাপতি সাধারণত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্যরা হয়ে থাকেন। আর জেনারেল হাসপাতালের ক্ষেত্রে কমিটির সভাপতি হন সিটি করপোরেশন মেয়র। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় কমিটির সভাপতিও কমিটির প্রধান হয়ে থাকেন। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, এর ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কমিটির সভাপতির পদ খালি পড়ে আছে।

বিগত সরকারের জারি করা গত ১৩ জুনের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, দেশের ৮টি বিভাগের ৮৩টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল , জেলা সদর হাসপাতালে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা মনোনীত ছিলেন। এসব হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে থাকেন হাসপাতালের পরিচালক কিংবা জেলা বা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক।

মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক বৈঠকে ব্যবস্থাপনা কমিটির বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালকদের মতামত জানতে চেয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। বৈঠকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ জানান, বর্তমানে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মত কেউ নেই। আমরা এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।

রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসিবুল ইসলাম সবুজ সভায় জানান, আমরা সভাপতির অনুপস্থিতিতে আগের কমিটি নিয়ে একাধিক সভা করেছি। এ বিষয়ে দেড় মাস আগে মন্ত্রণালয়ে লেখা হয়েছে, কিন্তু কোনও জবাব পাইনি। 

নুরজাহান বেগম এই সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হাসপাতাল কমিটির সভাপতি পদে রাখার বিষয়ে পরিচালকদের মতামত জানতে চান। জবাবে রাজশাহী ও সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকরা জানান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হাসপাতাল কমিটিতে রাখলে সমস্যা তৈরি হতে পারে।

এসময় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিভাগীয় শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সভাপতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনারদের রাখার প্রস্তাব দেন।

সভায় মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক জানান, হাসপাতালের কমিটি কেমন হবে, সে বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক জানান, বিদ্যমান কমিটিতে বিভিন্ন পেশাজীবী ও কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। তিনি আগের ফরমেটে প্রস্তাব দিতে হবে কিনা, তা জানতে চান।

এসময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, একেকজন একেক ফরমেটে দিলে সেক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য তৈরি হতে পারে, একটি সাধারণ ফরমেট থাকলে ভালো হয়।

এসময় উপদেষ্টা বলেন, আমরা কোনও নির্দিষ্ট ফরমেট দিতে চাই না। হাসপাতালের পরিচালকরা যাতে স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করে নাম প্রস্তাব করতে পারেন, সেটিই আমরা চাই। আগের ফরমেটে প্রস্তাব দেওয়া যাবে, আবার চাইলে নতুন ফরমেটেও দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র/ছাত্রী ছিলেন, হাসপাতালের উন্নয়নে কাজ করেছেন, চিকিৎসা সেবার মান বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারবেন, এরকম সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি কেউ থাকলে তাকে রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে কমিটিতে রাখার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে আমরা এ বিষয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে চাই না। পরিচালকরা যাকে উপযুক্ত মনে করবেন, তার নামই পাঠাতে পারবেন।

যন্ত্রপাতি ও জনবল সংকট : ব্যবস্থাপনা কমিটির পাশাপাশি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও জনবল নিয়ে আলোচনা হয় সভায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক জানান, যেকোনও সময় ক্যাথল্যাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তিনি জরুরি প্রয়োজনে খরচ করার জন্য পরিচালকদের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার অনুরোধ জানান।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক জানান, এক মাস আগে হাসপাতালের চোখ অপারেশন থিয়েটারসহ চক্ষু বিভাগ আগুনে পুড়ে গেছে।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক হাসপাতালে একটি এনজিওগ্রাম যন্ত্র দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক জানান, হাসপাতালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে জনবল পাঠানোর কথা থাকলেও তা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক জানান, চিকিৎসক পাঠানোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না থাকায় তা করা সম্ভব হয়নি।

নিরাপত্তার অভাব : সভায় হাসপাতালের নিরাপত্তা বিষয়েও আলোচনা হয়। রাজশাহী ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকরা উপদেষ্টাকে জানান, দায়িত্বরত আনসারের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার কারণে বর্তমানে হাসপাতালে নিরাপত্তা বজায় রাখা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

উপদেষ্টার পরামর্শ : এসময় উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বলেন, অনেক জায়গায় যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু তা পরিচালনার জন্য জনবল নেই। জনবলের অভাবে বা অন্য কোনও সমস্যার কারণে কোথাও কোনও যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত পড়ে থাকলে তা সমন্বয় করে অন্য জায়গায় দেওয়া যায়। হাসপাতালের অতিরিক্ত যন্ত্রপাতির তালিকা পাওয়ার পর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় উপযুক্ত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেবে। এক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করার প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি যাতে বন্দরে দীর্ঘ সময় পড়ে না থাকে, সে বিষয়ে সিএমএসডিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে অনেক পুলিশ কাজে যোগ দেয়নি, আনসারের সংখ্যাও কম। কাজেই সব জায়াগায় একইরকমভাবে আনসার দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি এ বিষয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে স্থানীয় অংশীজনদেরকে সম্পৃক্ত করে নিরাপত্তা পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য পরিচালকদের প্রতি নির্দেশনা দেন।

সভায় হাসপাতালের সেবার মান উন্নয়নে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে আছে হাসপাতালে সেবাপ্রার্থী ও দর্শনার্থীদের ভিড় নিয়ন্ত্রণে পরিচালকদেরকে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একজন রোগীর সঙ্গে একজন অ্যাটেনডেন্ট থাকবেন। রোগীদেরকে কার্ড প্রদানের মাধ্যমে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের জন্য সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে, যাতে রোগী দেখার মূল্যবান সময় নষ্ট না হয়। হাসপাতালের বারান্দা, সিঁড়ি, মেঝে ও বাথরুমসহ বিভিন্ন স্থানে যাতে অপরিকল্পিতভাবে রোগী না থাকে, সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আউটডোরে আগত বৃদ্ধ, শিশু, প্রসূতি বা অন্তঃসত্ত্বা মা এবং গুরুতর অসুস্থদের জন্য পৃথক লাইনের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। রোগীদের সুবিধার্থে হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভবন ও কক্ষ নির্দেশিকা টানাতে হবে। হাসপাতাল ভবন ও প্রাঙ্গণ থেকে দলীয় ও রাজনৈতিক পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করতে হবে। এর পরিবর্তে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে জনসচেতনতামূলক বার্তা দিয়ে সুদৃশ্য ডিসপ্লে বোর্ড তৈরি করা যেতে পারে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সারা দেশ থেকে আসা রোগীর চাপ কমাতে অন্যান্য হাসপাতালের জরুরি বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু রোগী যেসব হাসপাতালে চাপ কম, সেসব হাসপাতালে শিফট করা যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.