জসীমউদ্দীন ইতি ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি ॥ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিদ্যালয়ে সংগীত, শারীরিক শিক্ষা এবং চারুকলার জন্য ১০ হাজারের অধিক শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর মধ্যে সংগীত, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকের জন্য ৫ হাজার ১৬৬টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং চারুকলার শিক্ষকের জন্য পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে ৫ হাজারের অধিক।
ইতিমধ্যে ৯ হাজার ৫৭২টি সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ অনুমোদন হয়ে গেছে। সহকারী শিক্ষকদের প্রমোশন দিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক করা হবে। একই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কনসালটেশন কমিটি করা হয়েছে, যাদের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত করা হবে। আবার সহকারী শিক্ষকদের বদলি পদ্ধতি আরও কীভাবে সহজ করা যায় সেটা নিয়েও নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষায় অনেক সুখবর আসছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রে আরও জানা যায়, বর্তমান সরকারের তিন মাসে ২০৮ জন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৫৩১ জন। সরকার শিক্ষার্থীদের মিড-ডে মিলে যুক্ত করতে যাচ্ছে-ডিম, দুধ, পাউরুটি, কলা ও মৌসুমি ফল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনগুলো আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন করা হচ্ছে। অবহেলিত ও পথশিশুর শিক্ষার জন্য আবার সচল করা হচ্ছে শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এক বছরের বদলে দুই বছর করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আনতে চায়। এ জন্য একদিকে যেমন নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার মান উন্নয়নে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টিম করা হয়েছে। তাদের পরামর্শ নিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত করব। আমরা শিক্ষার্থীদের স্বার্থের দিক বিবেচনা করে তাদের মিড-ডে মিলে ভালো ভালো খাবার যুক্ত করব। একই সঙ্গে আমরা বিদ্যালয়ের ভবনগুলোও আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন করব। এ ছাড়া শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, বদলি পদ্ধতি সহজ করাসহ আরও অনেক নতুন সিদ্ধান্ত আমরা নিতে যাচ্ছি। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে আমরা দৃশ্যমান অনেক কিছু করব।
নতুন পদ সৃষ্টি : মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অনেক নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার ৫ হাজার ১৬৬টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও কিছু পদ তৈরি করা হবে। এ শিক্ষকদের যাতে নিয়োগ দেওয়া যায় তার জন্য নিয়োগ বিধিমালায় এসব পদ যুক্ত করা দরকার। সে প্রক্রিয়াও ইতিমধ্যে শুরু করা হয়েছে। এর ফাইল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পর সেটি পাঠানো হবে আইন মন্ত্রণালয়ে। এরপর বাকি কার্যক্রম সম্পন্ন করে ওইসব শিক্ষক নিয়োগের কাজ শুরু করা হবে।
তবে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেওয়া হবে না। এটা অঞ্চলভিত্তিক পদায়ন করা হবে। যেমন একটি অঞ্চলের কয়েকটি বিদ্যালয় মিলে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজারের ওপরে। এত বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষক দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে প্রথমে ক্লাস্টারভিত্তিক করা হবে, পরে পদ সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৯ হাজার ৫৭২টি সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদের সম্মতি মিলেছে বা অনুমোদন হয়ে গেছে। বর্তমানে যারা সহকারী শিক্ষক রয়েছেন তাদের মধ্য থেকে পদোন্নতি দিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ শতভাগ পূরণ করা হবে। পরে তারা প্রধান শিক্ষকও হতে পারবেন।
সহকারী শিক্ষকদের জন্য এ সুযোগ আগে ছিল না। সহকারী প্রধান শিক্ষক না থাকার কারণে স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক দৈনন্দিন কাজে অনেক সমস্যা দেখা দিত। কেননা প্রধান শিক্ষককে নানারকম কাজে কখনো উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ে যেতে হয় বিভিন্ন কাজে। প্রধান শিক্ষক উপস্থিত না থাকলে স্কুল অভিভাবকশূন্য হয়ে যায়। স্কুলের সার্বিক উন্নতি ও শৃঙ্খলার জন্য এ পদ সৃষ্টি করা খুবই দরকার ছিল মনে করে এসব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের তিন মাসে ২০৮ জন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিসিএসের নন-ক্যাডার থেকে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৬ হাজার ৫৩১ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের পরীক্ষা আগে নেওয়া ছিল। যেহেতু পরীক্ষাগুলো আগের সরকারের আমলে হয়েছিল, তাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে হয়েছে। এরপর এ মন্ত্রণালয় ও অধীন প্রতিষ্ঠানের ১৬৪ জন কর্মকতাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এরপর আরেকটি বড় কাজ করা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায়। বিদ্যালয়গুলোতে পিইডিপির আওতায় শিক্ষার্থীদের পুষ্টি ও খাদ্য কার্যক্রম চলে। এ প্রকল্প মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এবং এর চতুর্থ ফেজের কার্যক্রম চলছে। আগামী মাস, অর্থাৎ ডিসেম্বরেই এর কাজ শেষ হয়ে যেত, কিন্তু করোনার কারণে আগামী জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ কাজকে কীভাবে ভালোমতো শেষ করা যায় সেটা নিয়েও তৎপর রয়েছে মন্ত্রণালয়। কারণ এ প্রকল্পের কাজে প্রচুর বিদেশি ফান্ড রয়েছে। দেখা যায়, অনেক প্রকল্পেই কাজ শেষ না হওয়ার কারণে প্রকল্পের টাকা ফেরত যায়। তবে এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তেমনটি হচ্ছে না। এ প্রকল্পের কাজ পুরোটাই সফলভাবে করা হচ্ছে।
পিইডিপি প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীদের মিড-ডে মিলের কার্যক্রম শেষ হলে নতুন সরকার আবার নতুন করে এবং নতুন আঙ্গিকে চালু করবে, যাতে মিড-ডে মিলে শিশুদের পুষ্টির দিক বিবেচনা করে আরও নতুন নতুন আইটেম যুক্ত করা হবে। এটা প্রস্তুতের কাজ চলছে। পিইডিপি-৫-এর আওতায় এ মিড-ডে মিল পরিচালনা করা হবে। এর প্রথম ফেজে দেড়শ উপজেলাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এসব উপজেলার প্রত্যেক স্কুলের সব শিশু মিড-ডে মিল পাবে। একেক দিন একেক রকম খাবার দেওয়া হবে। খাবারের মধ্যে থাকবে ডিম, দুধ, পাউরুটি, কলা ও মৌসুমি ফল। ইতিমধ্যেই এ প্রকল্প নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রাথমিকের উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এটা অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প, দ্রুত পাস করতে হবে। প্রকল্প পাস হয়ে গেলে এ কার্যক্রম শুরু হবে।
প্রাথমিকের আরেকটি ভালো খবর হচ্ছে-কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৯৫০ কোটি টাকার একটি ফান্ড রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫০ কোটি টাকা বিশ্বব্যাংক দেবে অনুদান হিসেবে। প্রকল্পটি ইতিমধ্যে পাস হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি তার কাজ বুঝে নিয়েছেন। অর্থাৎ এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেছে।
মন্ত্রণালয় আরেকটি উদ্যোগ নিচ্ছে, সেটি হলো-ঢাকা মেট্রোপলিটন অঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৫৬টি। এর মধ্যে বেশিরভাগই পুরোনো স্কুল। এসব স্কুলের ভবনকে নতুন করে, দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা। ইতিমধ্যেই ২০৪টি স্কুলের কাজের প্ল্যান হয়ে গেছে। টেন্ডার হয়ে গেছে ১০৩টির। কাজ শুরু হয়েছে ৬৭টির। আর আগামী মাসের মধ্যেই আধুনিক আঙ্গিকের ১০টি বিদ্যালয় উদ্বোধন করা হবে। সুতরাং প্রাথমিক বিদ্যালয় বলতে যে দৃশ্যটা চোখে ভাসে তা পাল্টে যাবে। প্রথম ফেজে এ কার্যক্রম পরিচালিত হবে ঢাকার স্কুলে, পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই হবে।
আরও জানা যায়, আমরা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এক বছরের বদলে দুই বছর করা হচ্ছে। সুতরাং প্রি-প্রাইমারিতে এখন দুটি বছর যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারুকলার শিক্ষকের পদও সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটাও প্রথমে ক্লাস্টারভিত্তিক করা হবে এবং পর্যায়ক্রমে সারা দেশের স্কুলেই এ পদ সৃষ্টি করা হবে। চারুকলার শিক্ষকের পদও ৫ হাজারের অধিক হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে এতগুলো ভালো ভালো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য জেলাভিত্তিক পরিদর্শন টিম তৈরি করা হচ্ছে। তারা কী পরিদর্শন করবে, তাদের কাজ কী হবে, তার দিকনির্দেশনাও তৈরি করা হয়েছে।
প্রাথমিকের শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট আছে। যারা অবহেলিত বা পথশিশু তাদের লক্ষ্য করে ওই ট্রাস্টের অধীনে কিছু স্কুল পরিচালনা করা হয়। সকাল, দুপুর বা সন্ধ্যা-যখন এসব শিশুকে একত্রে পাওয়া যাবে বা একত্র করা যাবে তখন সেখানে এই স্কুল পরিচালনা করা হবে। এটা অনেকটা ভ্রাম্যমাণ স্কুলের মতো। এসব স্কুল পরিচালনার জন্য কাজ করে শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট। এ ট্রাস্ট অনেক দিন ধরেই অকার্যকর অবস্থায় ছিল। একে আবার সচল করা হচ্ছে। এসব স্কুলের শিক্ষকরা মূলত ওই ট্রাস্টের অধীনে নিয়োগ পান। এ ট্রাস্টে সরকার অনুদান দেয়। এ ছাড়া ট্রাস্টের নিজস্ব তহবিলও রয়েছে। এ দুই খাতের অর্থে স্কুলের খরচ বহন করা হবে।
প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বদলি কার্যক্রম খুবই জটিল করে রাখা হয়েছে। এ বদলি কার্যক্রম কীভাবে আরও সহজ করা যায় সেটা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করছে মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার মান ও সার্বিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ভালো কথা; কিন্তু আমাদের চাওয়া থাকবে সবার আগে কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নতি করা যায় সে উদ্যোগ যেন নেওয়া হয়।