টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও

প্রশান্তি ডেক্স ॥ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। কম দামে পণ্য পেতে প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক সেলের লাইনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের সঙ্গে এই লাইনে শামিল হচ্ছেন বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা।

গত বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় দেখা যায়, টিসিবি থেকে পণ্য কিনতে দীর্ঘ লাইন ধরেছেন সাধারণ মানুষ। শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষের পাশাপাশি পুরান ঢাকায় মেসে থাকা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও ছিলেন এই লাইনে।

টিসিবি সূত্রে জানা যায় রাজধানীর ৫০টি স্থানে ফ্যামিলি কার্ড ছাড়া বিশেষ ট্রাক সেলে পণ্য বিক্রি করে টিসিবি। প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য থাকে। তবে অধিকাংশ জায়গায়ই নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের চেয়ে বেশি মানুষ উপস্থিত থাকেন, যারা পণ্য কিনতে পারেন না।

টিসিবি থেকে পণ্য কিনতে দীর্ঘ লাইন ধরেছেন সাধারণ মানুষ টিসিবির এসব পণ্যের মধ্যে লিটারপ্রতি ভোজ্যতেল ১০০ টাকা, এক কেজি মসুর ডাল ৬০ টাকা, চাল ৩০ টাকা ও আলু ৪০ টাকায় কেনা যায়। এই চার পণ্য কিনতে একজন গ্রাহককে দিতে হচ্ছে ৫৯০ টাকা। খুচরা বাজার থেকে এসব পণ্য কিনতে লাগে প্রায় ১ হাজার টাকার মতো। অর্থাৎ, টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনলে অন্তত ৪শ’ টাকার বেশি সাশ্রয় হয় ক্রেতাদের।

পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় মেসে থাকেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসান। তিনি বলেন, সরকার পতনের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেমন ছিল এখনও তেমন। বরং কিছু কিছু পণ্যের দাম আরও বেড়েছে। এত বেড়েছে যে দোকান থেকে ক্রয় করে খাওয়াটাই কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। তাই সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি টিসিবির পণ্য কেনার।

কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী এনামুল হক বলেন, আগে মেসে তিন হাজার টাকার মধ্যে তিনবেলার খাবার হয়ে যেতো। এখন চার হাজার ছুঁয়ে গেছে। টিসিবিতে কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে তেল, পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। পরে মেসের সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সপ্তাহে অন্তত দুবার টিসিবির ট্রাক থেকে মালামাল কিনবো। এতে কিছু টাকা সাশ্রয় হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্রী বলেন, আমরা একসঙ্গে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন মেসে থাকি। কমবেশি সবারই আর্থিক সমস্যা আছে। তাই যে যেভাবে পারছি খরচ বাঁচানোর উপায় বের করছি। আমাদের মেস মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে সপ্তাহে একবার একজন টিসিবির লাইন থেকে বাজার করবে। আজকে আমার বাজার ছিল। ক্লাস মিস করে এক দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মেসের বাজার করলাম।

ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে যে দামে পণ্য কেনা যায় সেই, একই দামে যদি দোকানেও পাওয়া যেতো তাহলে আর বাড়তি কষ্ট করতে হতো না। অন্তবর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ, যাই করেন আর না করেন, অন্তত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণ মানুষের নাগালে আনেন। নয়তো গ্রামাঞ্চল থেকে এসে মেসে থেকে পড়াশোনা করা আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য আরও কষ্টসাধ্য হবে।

টিসিবির পণ্য-ক্রেতারা চাল-ডালের পাশাপাশি মাছ-মাংস ও সবজি বিক্রির দাবি জানান। টিসিবির লাইনে মাছ-মাংস ও সবজি বিক্রির দাবি মানুষের।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে সাধারণ মানুষ কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে কেবল চাল, ডাল, আলু এবং ভোজ্যতেল কিনতে পারেন। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় আর কোনোকিছুই বিক্রি হয় না। এবার ক্রেতারা চাল-ডালের পাশাপাশি টিসিবিকে মাছ-মাংস এবং সবজি বিক্রির দাবিও জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো গৃহিণী খাদিজাতুল কোবরা বলেন, টিসিবি থেকে শুধু চারটা জিনিস কেনা যায়। চাল, মসুর ডাল, আলু আর তেল। মাছ-মাংস বা কোনও তরকারি পাওয়া যায় না। যদি যেতো তাহলে খুব ভালো হতো।

খাদিজাতুল কোবরা আরও বলেন, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের অনেক দাম। টিসিবি থেকে যেহেতু কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে কেনা যায়। সেজন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, টিসিবি যেন মাছ-মাংস এবং তরকারিও বিক্রি করে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এই উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে আমাদের মতো মানুষ ঢাকা শহরে আরেকটু ভালো থাকতে পারবো।

টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো মোরশেদ আলম বলেন, বাজার থেকে এক কেজি করে কোনও তরকারি কেনা যায় না। যে মাছের দাম জানতে চাইবো সেটির কেজিই ৫০০ টাকার ওপরে। ছেলে মেয়েদের মাছ-মাংস না খাওয়াতে পারার আক্ষেপ যে কতটা, তা আমার মতো পরিস্থিতিতে যারা পড়েছেন তারা বুঝবেন।

কথা বলার একপর্যায়ে অশ্রুসিক্ত মোরশেদ বলেন, আমার ছোট মেয়েটা ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। একবার সে বায়না ধরেছে আমার সাথে বাজারে যাওয়ার। ওর মাও বললো নিয়ে যেতে। পরে গেলাম রায় সাহেব বাজারে। ছোট মেয়ে যা দেখে তাই কেনার কথা বলে। প্রথম প্রথম খারাপ না লাগলেও যখন বড় রুই মাছের কাছে গিয়ে মেয়েটা আর কোনোভাবেই সরছিল না। কিনতে না পেরে খুব খারাপ লেগেছে। বাবা হয়ে মেয়ের ছোট বায়না পূরণ করতে পারিনি।

এই ক্রেতা আরও বলেন, পত্রপত্রিকা আর টিভিতে শুধু এই উদ্যোগ, ওই উদ্যোগ এটা সংস্কার, ওটা সংস্কারের কথা শুনি। এসব দিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ কী করবো। আমরা চাই শুধু জিনিসপত্রের দাম যেন কমে। আগেও জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে ছিল, এখনও তাই আছে। বরং আগের সরকার টিসিবি দিয়ে যেই উদ্যোগ নিয়েছে তাতে আমরা কিছুটা স্বস্তি পাইছি। সেটা এখনও পাচ্ছি। এখন আমরা চাই টিসিবি যেন মাছ-মাংস-তরিতরকারিসহ সব প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করে। তাহলে আমাদের আর কিছু লাগবে না।

মাছ, মাংস এবং তরকারি বিক্রির বিষয়ে জামিল আহমেদ নামে টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাকের দায়িত্বরত একজন বলেন, টিসিবি থেকে যদি এসব বিক্রির ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তো আমাদের কোনও সমস্যা নাই। আমাদের দায়িত্ব তো শুধু লোকেশন অনুযায়ী ট্রাক নিয়ে যাওয়া আর পণ্য বিক্রি করা। কর্তৃপক্ষ যদি বর্তমানে যা বিক্রি করছি তার পাশাপাশি আরও কিছু বিক্রির ব্যবস্থা করেন, আমরা তা-ই করবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published.