চলতি অর্থবছরের বাজেট ছোট হচ্ছে

প্রশান্তি ডেক্স॥ ছোট করা হচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের কাটছাঁট হতে যাচ্ছে চলতি অর্থবছরের বাজেট। বাজেটের আকার ছোট করতে গিয়ে অনেক খাতেই কাটছাঁটের মাধ্যমে সংশোধন আনার পরিকল্পনা করছে সরকার। ইতোমধ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। এর মধ্য দিয়ে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি কমে যেতে পারে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের সভায় বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। ওই সভায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প বাদ দিয়ে বাজেট ৩০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সাত লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকায় প্রাক্কলন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। জারি করা পরিপত্রে অর্থ বিভাগ বলেছে, কোনও মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ চাইতে পারবে না এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। ইতোমধ্যে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও এদের অধীন বিভিন্ন দফতর স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাকে সংশোধিত বাজেটের প্রাক্কলন অর্থ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রণয়ন করা হয়েছিল। এরপর গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকারের পতনের পর অর্থবছরের এক মাস আট দিনের মাথায় ৮ আগস্ট অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। স্থানীয় ঠিকাদারেরা কাজ বন্ধ করে দেন এবং বিদেশি অনেক ঠিকাদার দেশ ছেড়ে চলে যান। সেপ্টেম্বরে কিছু প্রকল্প পুনরায় শুরু হলেও অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর।

সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের বাজেট কাটছাঁট করতে গিয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে আরও সাশ্রয় করা সম্ভব হলেও ঋণের সুদ পরিশোধ, বিক্ষোভে হতাহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা এবং অবকাঠামো মেরামতের জন্য বাড়তি ব্যয় দরকার হচ্ছে।

জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি বন্ডে উচ্চ সুদের হার (১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত) এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধি এর প্রধান কারণ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে চার বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার আশা করছে। যার মধ্যে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সরকার ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরের উৎস- যেমন সঞ্চয়পত্র ও ট্রেজারি বিলকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলেও জানা গেছে।

জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়, ভূমি অধিগ্রহণ খাতে পরিচালন বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনায় সীমিত আকারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এ সংক্রান্ত গত ৪ জুলাই অর্থ বিভাগের জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে। তবে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারের নিজস্ব অর্থে সব ধরনের বৈদেশিক ভ্রমণ, কর্মশালা ও সেমিনারে অংশগ্রহণও বন্ধ থাকবে। উন্নয়ন ও পরিচালন বাজেটের আওতায় মোটরযান, জলযান, আকাশযানসহ সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ থাকবে। কিন্তু পরিচালন বাজেটের আওতায় ১০ বছরের বেশি পুরোনো যানবাহন প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে অর্থ ব্যয় করা যাবে। পরিচালন বাজেটের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ছাড়া নতুন আবাসিক ভবন, অনাবাসিক ভবন এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে চলমান নির্মাণকাজ ন্যূনতম ৭০ শতাংশ শেষ হয়ে থাকলে অর্থ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ব্যয় নির্বাহ করা যাবে।

এদিকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নির্দেশে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নে ১৩ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা সীমিত রাখা, মূল সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দহীন কোনও প্রকল্প না রাখা, সরকারের কৌশলগত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে অগ্রাধিকার বাছাই করে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেওয়ার নির্দেশনা।

জানা গেছে, এডিপির আওতায় নেওয়া প্রকল্পগুলো উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই কাটছাঁটের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতে পাচ্ছে মেগা প্রকল্প এবং গোষ্ঠী স্বার্থের প্রকল্পগুলো। এতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি কমে যেতে পারে। কারণ জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ মাসের শেষে বা আগামী মাসে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পুনর্বিবেচনার জন্য বৈঠক হতে পারে। এই বাজেট পুনর্বিবেচনার বড় জায়গা হতে পারে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাজেট কাটছাঁট করার বিষয়টি সরকারের একটি ভালো সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমতির দিকে হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে। গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও তার সুফল বাংলাদেশ পায় না। আমাদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনের কারণ বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব ও সরবরাহ ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতিতে বড় কোনও পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’

তিনি জানান, ‘গত সরকারের প্রণীত বাজেটে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাজেটকে চাপে ফেলেছে। এটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। বিলাসী বিদেশ ভ্রমণ বাদ দিতে হবে। যতদূর জেনেছি, সরকার সেদিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাতিল করা হবে। সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের জন্য নতুন গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখা হয়েছে।’ এতে বাজেটের আকার কমবে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাজেট বাস্তবায়নে সহায়ক হবে বলেও মনে করেন অর্থ উপদেষ্টা।  

উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করে। এর মধ্যে এডিপি ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের বাজেটেই ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা অব্যবহৃত ছিল। এ বছর বড় ধরনের কাটছাঁট করে চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে অন্তত দেড় থেকে ২ লাখ কোটি টাকা সহজেই সাশ্রয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং রাজস্ব উভয় খাত থেকেই ব্যয় কমানো সম্ভব। রাজস্ব বাজেটে অনেক অপচয়মূলক ব্যয় বা বাড়তি ব্যয় বরাদ্দ রয়েছে। সেগুলো সহজেই কাটছাঁট করা যায়। অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক প্রকল্প বাদ দিয়ে উন্নয়ন বাজেট থেকে সহজেই ১ লাখ কোটি টাকার ওপর সাশ্রয় করা সম্ভব।

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বরাদ্দের মাত্র ১ দশমিক ০৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.