প্রশান্তি ডেক্স॥ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজ শিক্ষকরা শিক্ষকতার মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করেন। এই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয় সরকারি বা বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত একটি মডিউল রয়েছে।
অন্যদিকে টিচার্স ট্রেনিং (টিটি) কলেজের টিচার এডুকেটর (প্রভাষক থেকে অধ্যাপক) শিক্ষক তৈরির কারিগর হলেও তাদের নেই উন্নত প্রশিক্ষণ। উন্নত বিশ্বে টিচার এডুকেটরদের জন্য লং কোর্স রয়েছে, যা বাংলাদেশে নেই। আর শিক্ষকতার মৌলিক প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনও ধরনের প্রশিক্ষণ নেই সরকারি টিটি কলেজের শিক্ষক বা টিচার এডুকেটরদের। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যারা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে টিচার এডুকেটর হয়েছেন তাদের প্রশিক্ষণও অসম্পূর্ণ। ফলে যারা শিক্ষক তৈরি করবেন তাদের অবস্থায়ই বেহাল।
ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের টিচার এডুকেটর হিসেবে যেমন কোনও ধরনের প্রশিক্ষণ নেই, তেমনি এসব শিক্ষকের জন্য সরকারিভাবে নেই বেতন ভাতাও। এমনকি আর্থিক কোনও ধরনের প্রণোদনাও নেই। ফলে মানসম্মত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এটি বড় বাধা। অন্যদিকে সারা দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুই লাখ শিক্ষক এখনও প্রশিক্ষণবিহীন। প্রশিক্ষণ ছাড়াই তারা পাঠদান করছেন। ফলে সার্বিকভাবে মানসম্মত শিক্ষা অনিশ্চিত অবস্থাতেই রয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বলছেন, বছরের পর বছর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে না। যারা শেখাবেন তাদের সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে এর সমাধান না করা পর্যন্ত দেশে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করাও সম্ভব নয়। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষকদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থাই নেই।
বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও রাজধানীর ধানমন্ডির ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে রয়েছে ১৪টি, একটি বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বিএমটিটিআই) এবং ৭৬টি বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের আসন সংখ্যা চার হাজারের বেশি। বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের আসন ১৮ হাজারের বেশি। এই আসনগুলোর বড় একটি সংখ্যা শূন্য থাকে। অন্যদিকে দেশে এখনও দুই লাখের বেশি শিক্ষকের মৌলিক প্রশিক্ষণ (বিএড) নেই। যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের আর উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিক্ষকদের মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া, উপযুক্ত করে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
শিক্ষক প্রশিক্ষণের বর্তমান পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসন সংখ্যার বিবেচনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো। অথচ সরকারের কোনও প্রশিক্ষণ কোর্সে আমাদের সংযুক্ত করা হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অ্যাকাডেমি (নায়েম), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ (এনসিটিবি) কোনও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বেসরকারি টিটিসির টিচার এডুকেটরদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয় না। একসময় নায়েম বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিলেও অজ্ঞাত কারণে ২০১৬ সাল থেকে তা বন্ধ আছে। দীর্ঘ এই বঞ্চনা নিরসনে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। অন্য কোনোভাবে এর সমাধান নেই।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩২ বছর যাবৎ সরকারের কোনোরূপ আর্থিক সুবিধা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে কয়েক লাখ শিক্ষককে বিএড প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো। অথচ সরকারি ও বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই কোর্স-কারিকুলামে পরিচালিত হয়।
ঢাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক রিজিয়া সুলতানা বলেন, ‘সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য। টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষকদের জন্য টিচার্স গাইডও (টিজি) রয়েছে। সেই টিজি অনুযায়ী তারা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেন।’
বেসরকারি ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক এবং বেসরকারি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের চ্যালেঞ্জ সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সরকারের সিদ্ধান্ত।’
গত ৩০ নভেম্বর বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চলমান এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) নুজহাত ইয়াসমিন বলেন, ‘সারা দেশের এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণের আওতার বাইরে থাকা মোটেই সমীচীন নয়। বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোর নানাবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট উচ্চ মহলে পরামর্শ করে আশু সমাধান করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে সব শিক্ষকই যেন শিক্ষক সহায়িকা অনুযায়ী পাঠদান করেন।’
তিনি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে সারা দেশের প্রশিক্ষণের চাহিদা পূরণ করার জন্য ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) অধ্যাপক ড. সাঈদুর রহমান টিচার এডুকেটরদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিভিন্ন দাতা সংস্থার মাধ্যমে আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, যা পর্যাপ্ত নয়। পরবর্তীকালে আরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনলাইনে মাধ্যমিক শিক্ষকদের এটুআইয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’ তবে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষকদের বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনও বক্তব্য দেননি।
জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘এসব শিক্ষকদের অবশ্যই প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রশিক্ষণ ছাড়া ক্লাসে পাঠানো উচিত নয়। কিন্তু আমাদের যে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি, তাতে শর্ত দেওয়া থাকে না যে শিক্ষকতার মৌলিক প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ আবেদন করতে পারবেন না বা শিক্ষক হতে পারবেন না। এক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শর্ত আনা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে যারা শিক্ষক হয়ে গেছেন তাদের দ্রুত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কোনোভাবেই মৌলিক প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষককে ক্লাস নেওয়া উচিত হবে না। কারিকুলাম ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে এটা লাগবে।’
শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় প্রশিক্ষণে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা নিরসনের বিষয়ে অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘আমাদের চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে না পারলে, জীবন ধারণের জন্য যদি নিশ্চয়তা না থাকে তাহলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যেমন আগ্রহী হবেন না, তেমনি মানসম্মত শিক্ষা দিতেও তাদের আগ্রহ থাকবে না। এই শিক্ষকের কাছ থেকে মানসম্মত শিক্ষা আশা করা যায় না।’
ধানমন্ডির ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কলেজের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম খান আরও জানান, দেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত যত শিক্ষক প্রশিক্ষণবিহীন রয়েছে, দেশের সব টিটি কলেজের প্রতিটি আসনের বিপরীতে ভর্তি করিয় প্রশিক্ষণ দিতে সময় লাগবে ৯ বছরের বেশি। নতুন শিক্ষক নিয়োগ হলে সময় আরও বেশি লাগবে। তাছাড়া রয়েছে আরও নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। তাই আগামী ১৫ বছরেও সব শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্ভব হবে না। তবে সরকার আন্তরিক হলে ১৫-২০ বছরের মধ্যে সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের ভেতর আনা সম্ভব হবে।’ মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে এর বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।