প্রশান্তি ডেক্স॥ বসতবাড়ির পাশে পাঁচ বিঘা জমির ওপর খনন করা পুকুরের পানিতে মাছের লুকোচুরি খেলা। পুকুরের চার পাশের মাচায় ঝুলছে সারি সারি লাউ আর শীতকালীন সবজি। সমন্বিত এই কৃষি খামার করে চমক দেখিয়েছেন মর্জিনা বেগম। স্বামী, চার মেয়ে, এক ছেলে ও শাশুড়িসহ আট সদস্যের সংসারের সব কাজ এক হাতে সামলাচ্ছেন। পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে কৃষি খামার দিয়ে সফল কৃষি উদ্যোক্তা হয়ে গেলেন। একসময় সংসারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাওয়া গৃহবধূ মর্জিনা এখন স্বাবলম্বী। চলতি মৌসুমে ১৫ লাখ টাকার লাউ বিক্রির আশা করছেন এই উদ্যোক্তা।
মর্জিনা বেগম (৩৫) গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটী ইউনিয়নের টেংরা (উত্তরপাড়া) গ্রামের বাসিন্দা। গত বৃহস্পতিবার (০৫ ডিসেম্বর) তার কৃষি খামারে গেলে সফলতার গল্প শোনান এই নারী। সেইসঙ্গে জানিয়েছেন পরিবারের বর্তমান হালচাল ও আগের দুঃখ-কষ্টের কথা।
২০০৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের আগের দিন টেংরা গ্রামের স্যানিটারি মিস্ত্রি আকতারুজ্জামানের সঙ্গে বিয়ে হয় মর্জিনার। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। ২০০৫ সালে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। মর্জিনা-আকতারুজ্জামানের সংসারে চার মেয়ে, এক ছেলে। সবাই পড়াশোনা করছে। সংসারের সব সামলেও নিজে কিছু করার ইচ্ছে থেকে গড়েন কৃষি খামার।
মর্জিনার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২২ সালে বাড়ির পাশে খোলা জায়গায় খাওয়ার জন্য ডায়না জাতের লাউয়ের বীজ রোপণ করেন। ওই বছরে ভালো ফলন হওয়ায় পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশীদের দিয়ে স্থানীয় টেংরা বাজারে বিক্রি করেন। তখন লাউ ও সবজি চাষের কথা ভাবেন। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে বড় পরিসরে লাউ চাষের উদ্যোগ নেন। ২০২৩ সালে দেড় বিঘা জমিতে লাউ চাষ করেন। চলতি বছর অন্যের পাঁচ বিঘা জমির ওপর খনন করা পুকুর লিজ নেন। এজন্য স্বামীর কাছ থেকে এক লাখ ৫০ হাজার ও নিজের নাকফুল, কানের দুল এবং গলার চেইন বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা পান। দুই লাখ টাকায় নেওয়া লিজের পুকুরের চারপাশে ১৩০টি থলায় লাউয়ের চারা রোপণ করেন। বাড়ির উত্তর-পশ্চিম পাশে নিজের দেড় বিঘা জমিতে আরও ১০৮টি লাউয়ের চারা রোপণ করেছেন। মোট সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে মেটাল, লাল তীর ডায়না এবং পল্লবী; তিন জাতের ২৩৬টি চারায় প্রচুর পরিমাণ লাউ ধরেছে।
মর্জিনা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে পুকুর পাড়ে ২০০টি লাল তীর বীজ রোপণ করেন। এর মধ্যে ১৮০টি গাছে ফলন ভালো হয়। এখন তার বাগানে অন্তত পাঁচ হাজার লাউ ধরেছে। পাইকাররা বাগান থেকে লাউ নিজ হাতে কেটে নেন। প্রতি লাউ প্রকারভেদে ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন।
মর্জিনা বেগম বলেন, ‘স্বামী কাজে বেরিয়ে গেলে অলসভাবে বসে থাকা ভালো লাগতো না। ইচ্ছে জাগে বসতবাড়ির আশপাশে শাকসবজি ও ফলের বাগান গড়ে তোলার। সে চিন্তা থেকে চাষ শুরু করি। লাউ বিক্রি করে বাড়তি আয় হতে থাকে। সংসার খরচের বোঝা কমে যায়। সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে গাছের মাচা তৈরিতে বাঁশ, খুঁটি তৈরিসহ সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে এক লাখ টাকা। এ পর্যন্ত তিন লাখ টাকার লাউ বিক্রি করেছি। চলতি মৌসুমে ১৫ লাখ টাকার লাউ বিক্রির আশা করছি।’
সরেজমিনে দেখা যায়, তার সঙ্গে স্বামী, দুই মেয়ে লাউয়ের বাগানে কাজ করছেন। কীটনাশকের ব্যবহার এড়াতে আক্রান্ত লাউ এবং মরে যাওয়া পাতা কেটে ফেলে দিচ্ছেন। কোনও রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে শুধু জৈব সার দেন গাছে। এজন্য বিষমুক্ত লাউ হয়। লিজ নেওয়া পুকুরে মাছ চাষ করেছেন। মাছ বিক্রি করে আয়ের আশা করছেন মর্জিনা। স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে মর্জিনাকে পরামর্শ দেওয়া হয়। সার ওষুধ কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে, সে বিষয়ে স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সবসময় যোগাযোগ রাখেন।
স্থানীয় লাউ ব্যবসায়ী জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমি চলতি মৌসুমে মর্জিনা আপার ক্ষেত থেকে পাইকারি দামে লাউ কিনে আনি। প্রকারভেদে ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত দাম দিয়ে কিনি। ছাতির বাজার, লোহাই বাজার, শ্রীপুর বাজারে বিক্রি করি। ক্রেতারা লাউয়ের জন্য আমাকে খোঁজেন। কারণ এখানের লাউ মিষ্টি হয়।
এলাকার মা-বোনদের উদ্দেশে মর্জিনা বলেন, ‘বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের পতিত জমিতে লাউ চাষ করেন। লাউ চাষ খুব লাভজনক। এতে বেশি খরচ হয় না। জৈব সার দিয়ে লাউ চাষ করা যায়। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করলেও চলে। এতে নিজের পুষ্টি ও চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে লাভবান হতে পারবেন।’
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বন্যা বলেন, ‘শীতকালে লাউ জনপ্রিয় সবজি। চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১৭৫ হেক্টর জমিতে লাউ চাষ আবাদ হয়েছে। লাউ শাক আবাদ হয়েছে ৫৫ হেক্টর জমিতে। কৃষকরা ওসব জমির উৎপাদিত লাউ প্রায় আট কোটি টাকায় বিক্রি করবেন। আমাদের পক্ষ থেকে কৃষকদের লাউ চাষে বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও উৎসাহ দেওয়া হয়। টেংরা গ্রামের ওই নারী লাউ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। উপজেলায় সবচেয়ে বেশি লাউ চাষ হয় প্রহলাদপুর ইউনিয়নে। এরপর বরমী, কাওরাইদ এবং মাওনা ইউনিয়নেও প্রচুর লাউ চাষ হয়।’