প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশের বাজারে প্রতিনিয়তই বাড়ছে চালের দাম। সম্প্রতি খুচরা পর্যায়ে কেজিতে চালের দাম পাঁচ টাকা থেকে আট টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না চালের বাজার। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়া, হাট-বাজার-সড়কে অব্যাহত চাঁদাবাজি, আমদানি করা চাল না আসা, সরকারের সংগ্রহ টার্গেট ফেল করা, কয়েক স্তরে হাতবদল, সরকারি মজুত কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অব্যাহতভাবে বাড়ছে চালের দাম। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ও চালের বিভিন্ন বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট, আগস্ট-২০২৪ শীর্ষক বাংলাদেশের দানাদার খাদ্য বিষয়ক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে বন্যায় ধানের ব্যাপক ক্ষতির কারণে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চালের উৎপাদন ৩ শতাংশ কমতে পারে। এই অর্থবছরে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৮ লাখ টন হতে পারে। ধান হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের তুলনায় সাড়ে ৩ শতাংশ কম। বছরে মোট চালের চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ টনের বেশি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা চালের দাম বাড়ার প্রধান ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছেন।
১. অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেড়েছে চালের দাম:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও ভারতসহ উজানের দেশগুলো থেকে আসা ঢলে আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন। বাজারে চালের দাম বাড়ার এটি একটি বড় কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আমন চাল উৎপাদনের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে চার কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টনের মতো হয় আমনে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কোনও মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হলে চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যায় বোরো মৌসুমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি মোটা চালের দাম ৭ থেকে ৯ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
২. চালের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম:
সূত্র জানিয়েছে, চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে ধানসহ চালের দাম বেড়েছে। সরকারি ভাষ্যমতে সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১২ শতাংশ। এটি যদি সত্য হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম ১২ শতাংশ বাড়ার কথা। কারণ বিশ্লেষণ করে সংম্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন খরচ বেড়েছে, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। বেড়েছে কৃষি যন্ত্রপাতির দাম। বেড়েছে সার, কীটনাশকের দামও। আরও বেড়েছে ক্ষেতে পানি সরবরাহ দেওয়ার ডিজেল-কেরোসিন ও বিদ্যুতের দাম। তাছাড়া সার্বিকভাবে বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। এসব কারণে চালের দাম বেড়েছে। কারণ কৃষককে ধান বা চাল বিক্রি করেই সারা বছর জীবন চালাতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই বাজার থেকে যখন বেশি দাম দিয়ে চাল ছাড়া অন্য পণ্য কিনবে, তখন সেসব পণ্য কেনার অর্থ ওই কৃষককে ধান ও চাল বিক্রি করেই উপার্জন করতে হবে।
৩. হাটে-বাজারে-সড়কে চাঁদাবাজির কারণে বেড়েছে চালের দাম:
সূত্র জানিয়েছে, অন্তরবর্তী সরকারের নানামুখী উদ্যোগেও কমেনি চাঁদাবাজি। হাতবদলের পরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে চাঁদাবাজরা। যার প্রভাব পড়ছে বাজারগুলোতে। ফলশ্রুতিতে বাড়ছে চালের দাম। হাসিনা সরকারের পতনের পর মাসখানেক বন্ধ থাকলেও চাঁদাবাজরা ভোল পাল্টে আবার মাঠে সক্রিয় হয়েছে। এ কারণে চালসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যই চড়া দামে বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। একজন ব্যবসায়ীকে হাটে, বাজারে, সড়কে, মহাসড়কে, আড়তে, পাইকারি বাজারে, খুচরা বাজারে এবং মহল্লার দোকানে পর্যন্ত বিভিন্ন কায়দায় চাঁদা দিতে হচ্ছে। এ চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সংম্লিষ্টরা বলছেন, এখন আবার আগের অবস্থায় চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেট ফিরে এসেছে। শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতবদল হয়েছে মাত্র।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সম্প্রতি বলেন, বাজার সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়ে।
৪. চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় বেড়েছে চালের দাম:
গংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ায় সরকারের সিদ্ধান্তের পরেও চাল আমদানি পরিস্থিতি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। সারা দেশে খুচরা বাজারে খাদ্যশস্যের দাম আরও নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে সরকার বেসরকারি খাতকে এক মাসের মধ্যে ৩ লাখ ২৭ হাজার টন চাল আমদানি করতে বলেছে। মোট ৫৯ জন চাল আমদানিকারক ইতোমধ্যে উল্লিখিত পরিমাণ চাল আমদানির সরকারি অনুমোদন পেয়েছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়েছে, মোট চালের মধ্যে ২ লাখ ৪৭ হাজার টন সিদ্ধ এবং ৮০ হাজার টন আতপ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান হোছাইনী জানিয়েছেন, খুচরা বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে আমরা ৫৯টি কোম্পানিকে ৩ লাখ ২৭ হাজার টন সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছি। বেসরকারি আমদানিকারকদের বিগত ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে চাল বাজারজাত করতে হবে বলেও আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি খাতে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের খাদ্য মজুত হয়েছে ১২ লাখ ১৬ হাজার ০২২ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৭ লাখ ৯২ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন চাল, ৪ লাখ ১৭ হাজার ৯১৭ মেট্রিক টন গম এবং বাকি ৮ হাজার ৩৪৪ টন ধান। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভারত থেকে চাল আমদানির শেষ দিন ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ২৫ দিনে বেনাপোল স্থলবন্দরে মাত্র তিন হাজার ৩২০ টন চাল আমদানি হয়েছে। এর আগে সরকার দেশের ৯২টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে তিন লাখ ৯২ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে চাল আমদানির অনুমতি ছিল ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অন্য দেশ থেকেও জাল আমদানির সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের। কিন্তু ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে কী পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে তার কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
এদিকে অন্তরর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চাল সংগ্রহে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ২২ লাখ টন খাদ্য মজুত আছে। সেটিকে ৩০ লাখ করার জন্য কাজ করছে সরকার। আমদানির ক্ষেত্রে আমরা একক কোনও দেশের ওপর নির্ভর করবো না। যেহেতু আমাদের খাদ্য ঘাটতি আছে, আমরা অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে সে ঘাটতি পূরণ করবো। আমরা সে চেষ্টা করছি। ভারত থেকে চাল আমদানির বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, যখন দেশে চালের ভালো উৎপাদন হয়, সেক্ষেত্রে আমদানির পরিমাণ কম হয়। তবে ঘাটটি পূরণের জন্য মাঝে মধ্যে আমদানি করতে হয়। এবারে বন্যায় পূর্বাঞ্চলে কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছেু খাদ্য ঘাটতি হতে পারে। এ জন্য আমরা আমদানির সিদ্ধা— নিয়েছি।
৫. কয়েক স্তরে হাতবদলের কারণে বাজারে বাড়ে চালের দাম:
জানা গেছে, উৎপাদনকারী কৃষকের মাঠ থেকে খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ভোক্তার হাতে চাল তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েক স্তরে হাতবদল হয়। প্রত্যেক স্তরেই মুনাফা লাভের কারণে সার্বিকভাবে বেড়ে যায় চালের দাম। সরকারের কোনও উদ্যোগেই হাতবদলের এই স্তর সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। কৃষকের গোলার ধান মিলারদের কাছে যায়। সেখান থেকে মোকামের আড়তদার, মোকামের আড়তদার থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের চালের আড়তদার, সেখান থেকে হাতবদল হয়ে পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ী, সেখান থেকে খুচরা ব্যবসায়ী হয়ে ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে হয় চাল। পরিবহন খরচ বাদ দিয়ে প্রত্যেক স্তরেই কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা মুনাফা ধরে হাতবদল হওয়ার কারণে প্রতি কেজি চালের দাম বাড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা। ফলে ৫০ টাকার চালের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ থেকে ৭০ টাকা।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সম্প্রতি বলেন, সমবায় পদ্ধতি এখনও দেশে চালু করা যায়নি। চার থেকে পাঁচ হাতবদলে দাম বাড়ছে পণ্যের। তবে সমবায় পদ্ধতি অবলম্বন করলে বাজারে এই অস্থিরতা থাকতো না।
৬. অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ব্যর্থ হওয়ায় বেড়েছে চালের দাম:
জানা গেছে, আমন মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়েছে বলেই বাজারে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম হওয়ার গুজবে বেড়েছে চালের দাম। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আমন সংগ্রহ হয়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৪৭২ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ধান ৭ হাজার ৯৬১ মেট্রিক টন। সিদ্ধ চাল ২ লাখ ১০ হাজার ৫৪১ মেট্রিক টন ও আতপ চাল ৩৩ হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন। একদিকে মজুত কমে যাওয়া, অপর দিকে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ কাঙ্ক্ষিত হারে না হওয়ার কারণে বাজারে চালের দাম বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক জানিয়েছেন, সরকারি হিসেবেই ধানের উৎপাদন খরচ ১২ শতাংশ বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে, তা কমানো সম্ভব নয়। জোর করে চালের দাম কমাতে চাইলে কৃষক উৎপাদনের উৎসাহ হারাবে। কৃষক ধান উৎপাদনের উৎসাহ হারালে নতুন জটিলতা দেখা দেবে। তাই এ পথ পরিহার করে গরিব সাধারণ মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে চাল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূইয়া জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর চালসহ নিত্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু এর কিছু দিন পর থেকে আবার দাম বাড়তে শুরু করে। এর কারণ বাজারের পুরোনো খেলোয়াড়রা আবার সক্রিয় হয়েছে।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সমাজ থেকে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। আপনারা চাঁদা দেবেন না, যারা চাঁদা নিতে আসে তারা কীভাবে চাঁদা নেয়, সেটা আমরা দেখবো। চাঁদাবাজির জন্য নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমি কাজ করছি, দ্রুতই আপনারা দেখতে পারবেন।