পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফরে গুরুত্ব পেতে পারে জিডিআই

প্রশান্তি ডেক্স ॥ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের চীন সফরের প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর আমন্ত্রণে বেইজিং সফর করবেন উপদেষ্টা। চীন সফর উপলক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরতে আগামী সপ্তাহে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়নের অংশীদার হচ্ছে চীন। ঢাকার প্রতি আগ্রহও রয়েছে বেইজিংয়ের। নতুন প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতায় অন্তবর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বড় ধরনের এনগেজমেন্ট না হলেও আগামী দিনগুলোতে সম্পর্কে রূপরেখা নির্ধারণে ইতিবাচক আলোচনার সুযোগ থাকবে বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিকরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য চীনের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভসহ অন্যান্য উদ্যোগ ব্যবহার করে— বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনায় গুরুত্ব পেতে পারে জিডিআই।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো মো. শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক বিবর্তিত হচ্ছে জটিল ও বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক ক্যানভাসের প্রেক্ষাপটে। গত দুই শতাব্দী পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখন তাদের ক্ষমতার প্রভাব কমে আসছে এবং এশিয়ার দেশগুলো খুব দ্রুত শক্তিশালী হচ্ছে।’

সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন,‘গত এক দশকে চীন চারটি বহুমাত্রিক উদ্যোগ শুরু করেছে এবং সেগুলো তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে অনেক বেশি শক্তিশালী করেছে। এশিয়া এবং সারা বিশ্বে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য এবং একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার অংশ হিসেবে বেইজিংয়ের এই উদ্যোগ। বাংলাদেশকে এই নতুন বাস্তবতায় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

উল্লেখ্য, চীনের বহুমাত্রিক চার উদ্যোগ হচ্ছে— বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ। এর মধ্যে বাংলাদেশ ২০১৬ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া ২০২২ সালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর ঢাকা সফরের সময়ে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছিল।

জিডিআই এবং বাংলাদেশ :

২০২২ সালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের পর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে (জিডিআই) যুক্ত হওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকাকে প্রস্তাব দেয় বেইজিং। প্রস্তাবের সঙ্গে ৩২ দফা-বিশিষ্ট জিডিআই ডকুমেন্টও বাংলাদেশকে সরবরাহ করা হয়।

জিডিআই প্রস্তাবের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তখন একটি কমিটি গঠন করা হয়। ধারণা করা হয়েছিল, জিডিআই’র প্রস্তাবের ধরন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে গত জুলাই মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময়ে বাংলাদেশ এই উদ্যোগে যুক্ত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যুক্ত হয়নি।

টেক্সট ইজ অলরাইট, বাট নট দ্য কনটেক্সট :

২০২৩ সালে জিডিআই-বিষয়ক একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে চীন। ওই সম্মেলন বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নেন। সম্মেলন শেষে বেইজিং অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে একটি সমাপনী বিবৃতি প্রকাশ করার উদ্যোগে বাংলাদেশের সম্মতি চাইলে তৎকালীন ঢাকা সরকারের পক্ষ থেকে বিবেচনা করা হয় যে—  বিবৃতির ভাষা ঠিক আছে। কিন্তু প্রেক্ষাপট ঠিক নেই। টেক্সট ইজ অলরাইট, বাট নট দ্য কনটেক্সট।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন,‘চীন যখন বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ (বিআরআই) নিয়ে কাজ শুরু করে, তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। প্রথম দিকে বিআরআই উদ্যোগ খুব একটা পরিষ্কার ছিল না। সেটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাঝেও বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল।’

তিনি বলেন,‘আমাদের কাছে এটি পরিষ্কার ছিল যে, এটি শুধু অবকাঠামো প্রকল্প বা ব্যবসা নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে ভূ-রাজনীতি।’

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনও দয়া-দাক্ষিণ্য নেই এবং এটি আশা করাও ঠিক না। এখানে শুধু জাতীয় স্বার্থ কাজ করে বলে তিনি জানান।

শহীদুল হক আরও বলেন,‘চীনের বহুমাত্রিক পররাষ্ট্রনীতিতে জিডিআই’র গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক বিআরআই ও জিডিআই’র মাধ্যমে বিবর্তিত হবে বলে মনে হয়। সেজন্য জিডিআইতে যুক্ত হতে দেরি করলে সেটি ঢাকা-বেইজিং ইতিবাচক সম্পর্কের জন্য সহায়ক হবে না।’

ফ্রেন্ডস অব জিডিআই

বিশ্বের অনেক দেশ সরাসরি জিডিআই-তে যুক্ত হয়নি। ওইসব দেশ ‘ফ্রেন্ডস অব জিডিআই’তে যুক্ত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, তারা জিডিআইকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে— তার মধ্যে জিডিআইসহ অন্যান্য উদ্যোগ রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে হলে কোনও না কোনোভাবে জিডিআই উদ্যোগে বাংলাদেশকে যুক্ত হতে হবে।’

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বাংলাদেশ যদি সরাসরি ডিজিআইতে যুক্ত হতে না পারে বা না চায়, তবে ফ্রেন্ডস অব জিডিআইতে যুক্ত হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ৭০টিরও বেশি দেশ এই ক্লাবের সদস্য। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সবার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বিকল্প পথে চীনের সঙ্গে এনগেজমেন্টে যেতে পারে সরকার।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.