না ফেরার দেশে চলে গেলেন মান্নান স্যার

প্রশান্তি ডেক্স ॥ চিরস্থায়ী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে সকলের প্রীয় গণীতের ফেরিওয়ালাখ্যাত সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমার প্রীয় মান্নান স্যার। মান্নান স্যার একটি জনপ্রীয় নাম এবং তিনি সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের সকলেরই প্রীয় এবং শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। সবাই তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন; যা তিনি তিলে তিলে অর্জন করেছেন তাঁর জীবনের কর্ম ও ব্যবহার আর জীবনাচরন দিয়ে। তিনি জ্ঞান বিলিয়ে যেতেন আর মানুষ গড়ার কারিঘর এবং সমাজ বিনির্মানের সুতিকাঘারে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর দেয়া জ্ঞান ও শিক্ষায় এলাকার তথা এলাকার বাইরের অনেকেই আজ সু প্রতিষ্ঠিত; কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রফেসর, কেউ কেউ আবার এসপি, ডিসি, ডিআইজি, ম্যাজিষ্ট্রেট, সচিব, মন্ত্রি, এমপি, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বিভিন্ন সংগঠনের প্রধান, কেউ চেয়ারম্যান, কেউ মেম্বার এবং ইমাম ও সমাজের নেতৃত্ব দেয়ার অীধকারী আর স্ব স্ব ক্ষেত্রে সু প্রতিষ্ঠিত যার মাধ্যমে তিনি সমাজের সর্বস্তরে তাঁর বিচরণ এইভাবেই প্রকাশিত ও দৃশ্যমান রেখেছেন।

আজ তাঁর প্রয়াণে সবাই ব্যাথিত এবং মহা শুন্যতায় একত্রে জড়িয়ে এই মহান মানবের জয়গান বা স্তুতি প্রকাশ করছেন। আল্লাহ তায়ালা এই মহান মানুষটিকে বেহেস্তেও এইরকম সম্মানেই রাখবেন। তাঁর জীবনের শুরু থেকেই তিনি ঐতিহ্যবাহি এবং জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত পরিবারের একজন ছিলেন। তাঁর বড় ভাইও এই একই রকম আলোর দিশারী ছিলেন।

তিনি গত বৃহস্পতিবার সন্ধে আনুমানিক ৬.০৩ মিনিটে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৯৯ বছর। তাঁর অগনিত গুনগ্রাহীর সাথে রেখে গেছেন ৭ ছেলে ও ৩ মেয়ে। তারা প্রত্যেকেই সু প্রতিষ্ঠীত।

মান্নান স্যারের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো আত্মার এবং পরবর্তীতে তিনি আত্মীয় হয়েও সেই আত্মার সম্পর্কেই শেষদিন পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলেন এবং আছেন ও থাকবেন। আমার অংকের টিচার প্রয়োজন আর অংক শিখার নেশায় বোর্ড ষ্ট্যন্ড, গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত এমনকি এলাকায় জনপ্রীয় শিক্ষকদের নিকট অংক শিখতে গিয়ে শিখতে না পেরে মুখস্ত বিদ্যায় অভ্যস্ত হয়ে কোন রকমে পাশ শব্দটি অর্জন করতাম। কিন্তু আমার বন্ধু ফারুক এবং শিপন সব সময় মান্নান স্যারের গল্প করত এবং ফারুক মান্নান স্যারের কাছে পড়ত। সেই থেকে আমার খায়েশ জাগে পড়ার। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে একা কোন টিউশন করতেন না বরং বিশাল ব্যাচে পড়াতেন। সেই সুবাদে একদিন কুটি মিরপুকুর পাড় এবং ওনার কাঠের দোকানে গিয়ে দেখা করি। আমাকে পড়ানোর জন্য অনুরোধ করি। তখন তিনি বলেন আপনা হরিই ছালাম পাইনা মইয়ুরী আইসা ধাইর পিরা ভাই। এই কথা শুনে বুঝলাম ওনার স্কুলের ছেলে মেয়েরাই সুযোগ পায় না এখন বাইরের স্কুলের ছেলে মেয়েরা এসে গোরাফিরা করছে। তাই ওনি আমাকে খুব ভোরে ফজরের পরে একটি সুযোগ দেয়। আমি সেই শিতের সকালে ভোর বেলায় ওনার বাড়িতে গিয়ে খাতা কলম ছাড়াই অংকের হাফেজ হয়েছিলাম। এই অত্যাশ্চয্য বিষয়টি ইতিহাসের বিরল অধ্যায় এবং স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। তিনি অংক মুখে মুখে সমাধান করা শিখিয়েছেন। পাটিগতিন প্রশ্ন পড়েই ফলাফল বেড় করা শিখিয়েছেন। জ্যামিতি প্রশ্ন পড়েই বিস্তারিত চিত্র ও বিশ্নেষন করার সক্ষমতা অর্জন করিয়েছেন আর বিজগণিত ৫ সেকেন্ডে ফলাফল প্রকাশে সক্ষমতা দিয়েছেন। এই সেই কারিঘর মান্নান স্যার। কিছুদিন পর তিনি আমার শৈশবের স্কুলেই হেডস্যার হিসেবে যোগদান করেছেন এবং সেখানে আমাকে তার ব্যাচে রিহাস্যাল দেয়াতে ব্যবহার করতেন। মাঝে মাঝে ওল্লুখ শব্দ উচ্চারন করে হারানো খ্যায় ফিরিয়ে দিতেন।

এইভাবেই আমার সঙ্গে তাঁর সর্ম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পায় এবং আমি যখন একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করি তখন তিনি আমাকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করেন। সকল প্রতিকুল পরিবেশ মোকাবিলা করে তিনি ঐ মহৎ কাজে আকুন্ঠ সমর্থন ও অব্যাহত সহযোগী অক্ষুন্ন রাখেন এবং সেই স্কুলটি আজও তাঁর স্বীকৃতি হিসেবে সমুজ্জ্বল রয়েছে। আমার ব্যবসায়ীক সময়ে তিনি আমার প্রতিষ্ঠানে সবসময়ই যেতেন। কারণ কসবা উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে প্রয়োজন হতো। একদিন স্যার বলল টিএনও সাহেব গড়িমসি করে ফাইল সইদিতে। তখন টিএনও ছিল আবদুল গণি সাহেব। গণি সাহেব প্রতিদিনই আমার সাথে বসে আড্ডা দিতেন। কারণ আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সবারই যাতায়ত ছিল। আমি গণি সাহেবকে বলি যে স্যার আর কোনদিন আপনার কাছে সই নিতে আসবে না বরং ওনার পিউন অথবা গোলাম নবী (আমার ম্যানেজার) আসবে। টিএনও সাহেব বলেন, নিজে উদ্যোগি হয়েই আমি করে দিব এখন থেকে। তখন আমি বল্লাম উনি আমার আত্মার আত্মীয় এবং মা বাবার পরের স্থান অধিকারী ব্যক্তি এমনকি আমার শ্বশুরের নানা। সেই স্যার ঢাকা আসলে আমার খোজ নিতেন কখনো বাসায়ও আসতেন, ঈদের দিন আমার গ্রামের বাড়িতে আমার মাকে দেখতেন এবং আমার খোজ নিতেন। আর কোনদিন এই স্মৃতিময় দিনগুলো আসবে না। এটাই বড় কষ্টের এবং এই স্মৃতিগুলোই এখন আমার কাছে স্বপ্নের। তিনি এভাবেই তার ছাত্রদের এবং প্রীয় সন্তানদের আগলে রাখতেন।

মজার বিষয় হলো আমার ভাই বোনেরাও স্যারের ছাত্র ছিল এবং আছে ও থাকবে। স্যার ছেলে আমার বন্ধু, আমার ভাইদের বন্ধু, বোনের বান্ধবি এবং এক ছেলে ভাতিজি জামাই এই মিলে কত বন্ধনে আবদ্ধ এই পরিবার। আল্লাহ তুমি এই পরিবারকে আগলে রাখ এবং স্যারের অবর্তমানে তুমি এদের সকলের অভিভাবক হয়ে অভিবাভকত্ত্ব কর। আমি তাদের সকলের জন্য মোনাজাত করি এবং করব যাতে তারা তোমার আশির্বাদে যুক্ত থাকে।

১৯৬৩ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে কুটি অটল বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে গণীত শিক্ষক হিসেবে চাকুরীর সুবাদে গণীতের ফেরিওয়ালা খ্যাতির যাত্রারম্ভ করেন। পরবর্তীতে তিনি আলহাজ্জ্ব সৈয়দ মনিরুল হক উচ্চ বিদ্যালয় (সৈয়দাবাদ) প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং শেষ অব্দি প্রধান শিক্ষক থেকে তিনি অবসর গ্রহন করেন। বড় সুনামের সাথে তিনি তাঁর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন এবং গণীতের ফেরিওয়ালার খ্যতির শিখড়ে পৌঁছেন। গত শুক্রবার বাদ জুম্মা তাঁর নিজ গ্রামে মীরপুকুরপারে অর্ধলক্ষাধীক শুভানুধ্যায়ীর ইসলামী আয়োজনে জানাজার মাধ্যমে পারিবারিক কবরস্থানে চিরস্থায়ী নিদ্রার বিছানায় শায়িত হন। চীর ভাস্বর এবং চীর অম্লাম এই বিদায় এবং প্রস্থান আমাদের জীবনকে স্মরণে রাখবে প্রীয় মান্নান স্যার। আরো কতো স্মৃতি বিজরিত রয়েছে এই স্যারের সঙ্গে। একটি বিষয় হলো আমার এস এস সি পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যাল দেয়ার সময় আমি একজন পরীক্ষকের সাথে বেয়াদবী করি এবং সেই সময় রতন স্যার ও মান্নান স্যার এসে এই সমস্যা সমাধান করেন। তিনি বলেন আরে শুনেন শুনেন ও তে আমার প্রীয় ছাত্র মাফ করেদিন। যা যা মাফ চা আর বেয়াদবি করিস না ওল্লুখ। হৃদয়ে গেঁথে থাকবে আপনার নাম ও কৃর্তী এবং স্মৃতিময় দিনগুলো। ভালো থাকেন এই কামনাই করি। আপনি আগে চলে গেলেন আমরাও আসছি। দেখা হবে এবং নতুন স্মৃতি ও জ্ঞান আস্বাদনে আপনার স্মরণাপন্ন আবারও হবো ইনশাআল্লাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.