রাতের ঢাকা যেন ছিনতাইকারীদের স্বর্গরাজ্য

প্রশান্তি ডেক্স ॥ রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাজবংশী। গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) রাতে দিকে দোকান বন্ধ করে ৭০ ভরি স্বর্ণ ও প্রায় চার লাখ টাকা নিয়ে মোটরসাইকেলে হাজারীবাগের বাসায় যাচ্ছিলেন। সেকশন ঢালে আসতেই কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে দুর্বৃত্তরা তার পায়ে গুলি করে স্বর্ণ ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এর আগে গত ২১ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) রাত সাড়ে ৯টার দিকে গুলশান ২ নম্বর ডিসিসি মার্কেটের মানি এক্সচেঞ্জের মালিকসহ দুজনকে কুপিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা কোটি টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায়। ‘সিটি মানিটারি এক্সচেঞ্জের’ মালিক আব্দুল কাদের শিকদার জানান, তিনি ও তার শ্যালক আমির হামজা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে মোটরসাইকেলে করে বাসায় যাচ্ছিলেন। ডিসিসি মার্কেটের সামনে ১৫ থেকে ২০ জন তাদের মোটরসাইকেল থামিয়ে রড ও ছুরি দিয়ে আঘাত করে তাদের কাছে থাকা নগদ প্রায় কোটি টাকাসহ ব্যাগটি নিয়ে চলে যায়। এর আগে গত ২০ জানুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে পল্টনের বিজয়নগরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে সাজু মোল্লা (২২) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন।

এভাবে প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে। রাজধানীতে প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন বাসিন্দারা।

ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারাচ্ছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। দিন দিন চুরি, ছিনতাই এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় অনিরাপদ হয়ে উঠছে শহরের অলি-গলি। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে সাধারণ মানুষর মধ্যে। সম্প্রতি শহরে নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ব্যাপকভাবে বাড়ছে, বিশেষ করে রাস্তাঘাটে ছিনতাই এবং হোল্ড-আপের ঘটনা।

রাত হলেই যেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে ঢাকা শহরের ব্যস্ততম সড়কগুলো। রাজধানীর অপরাধপ্রবণ ব্যস্ত এলাকাগুলোতে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছিনতাইকারীরা ঘুরে বেয়ায় এবং সুযোগ বুঝে পথচারীদের ওপর হামলা চালায়। কিছু ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল আরোহীরা তাদের টার্গেট হয়ে থাকেন। তারা দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে মোবাইল ফোন, ব্যাগ বা অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

বিশেষ করে হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, পল্টন, শাহবাগ, তেজগাঁও ও মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের ঘটনা  বেড়ে গেছে। বিশেষ করে রাত নামতেই একাকী চলতে থাকা পথচারীদের টার্গেট করে এসব ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে রাজধানীতে অপরাধের ঘটনা প্রায় ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কিছু মাসে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আনতে গত শনিবার (২৫ জানুয়ারি) ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তার বলেন, ‘টঙ্গী বাজার এলাকা থেকে গাজীপুরা পর্যন্ত প্রতিদিনই ৬০-৭০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক দিনে টঙ্গী এলাকায় কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থী ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে পথচারী ও সাধারণ মানুষকে আঘাত করছে, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। ছিনতাই রোধে পুলিশ সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

মোহাম্মদপুর এলাকার এক ভুক্তভোগী জানান, “আমি সন্ধ্যায় বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ দুইজন মোটরসাইকেল আরোহী আমার পথরোধ করে। তাদের একজন আমার মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। চিৎকার করতে গেলে তারা অস্ত্র দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখায়।”

একই রকম ঘটনার শিকার হয়েছেন গুলশানের এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, “ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়ি ফেরার পথে আমার গাড়ি আটকে অস্ত্রের মুখে সব টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। থানায় অভিযোগ করার পরও কোনও অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না।”

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য বলছে, গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে দুই হাজার ৩৪৪টি। চুরি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে মামলা হয়েছে দুই হাজার ১৭৫টি। এছাড়াও শুধু রাজধানীতে বিভিন্ন ধরণের অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর সিংহভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয় না। বিশেষ করে মোবাইলসহ ছোট-খাট ছিনতাইয়ে ঘটনায় কোনও অভিযোগ দায়ের করেন না ভুক্তভোগীরা। ছিনতাইয়ে ঘটনায় নিহত, গুরুতর আহত কিংবা বড় কোনও ধরণের ছিনতাইয়ের ঘটনা হলে পুলিশের কাছে যায় ভুক্তভোগীরা। ফলে প্রকৃত ছিনতাইয়ের ঘটনার তথ্য থাকে না পুলিশের কাছে।

রাজধানীর অপরাধ কমাতে পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। সম্প্রতি ডিএমপি পুলিশ কমিশনার জানিয়েছে, অপরাধীদের চিহ্নিত করার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা, পেট্রলিং এবং গোপন সংবাদের মাধ্যমে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে, সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং অপরাধ প্রতিরোধে আরও কার্যকর পদক্ষেপের জন্য আবেদন করছেন। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কৌশলে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি জনবল এবং প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন। পাশাপাশি, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং এক্ষেত্রে সমাজের প্রতিটি স্তরের সহযোগিতা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও আধুনিকীকরণ ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রাজধানীর নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, অপরাধের বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। এই সমস্যাগুলো অপরাধীদের জন্য একপ্রকার ‘চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে ঢাকায় সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা কম থাকার কারণে অপরাধীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এছাড়াও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পেট্রলিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং পুলিশের বিভিন্ন নতুন কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন।

নগরবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুলিশকে সহযোগিতা করলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কিছুটা সহজ হতে পারে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ ওমর ফারুক বলেন, সাধারণ মানুষ যদি সতর্ক থাকে এবং সন্দেহজনক অবস্থায় পুলিশকে অবহিত করে, তবে অপরাধের সংখ্যা কমানো সম্ভব।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্‌) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আগের তুলনায় রাজধানীতে অপরাধ কমেছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। গত কয়েকমাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চিহ্নিত বিপুলসংখ্যক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.